৭ই মার্চের দিনলিপি

কিভাবে তৈরি হয়েছিল সেই আগুনঝরা ভাষণ? সকাল থেকে মঞ্চে ওঠার আগ পর্যন্ত দিনটি কিভাবে কেটেছিল বঙ্গবন্ধুর?

সকাল সাড়ে ৭টা

ঘরে বসে পত্রিকা পড়েই বেশ অস্থিরতার মধ্যে পড়ে গেছেন আবুল মনসুর আহমদ। পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে—শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, তিনি নাকি পরিষদে যাবেন না। এ  তো বড় সমস্যা! ভাবলেন  ফোন করে বিষয়টা বোঝাবেন। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি লাইনে বঙ্গবন্ধুকে পাচ্ছেন না। কিন্তু মনসুর সাহেবের অস্থিরতা কমছেই না। তিনি পাঠালেন তাঁর  ছেলেকে বঙ্গবন্ধুর বাসায়। যেন এক্ষুনি তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যোগাযোগ করেন।
 

সকাল ৯টা

এই বাড়ির দরজা কখনো বন্ধ হয় না। যে যখন ইচ্ছা ঢুকে পড়তে পারে। কিন্তু আজ একটু বেশি মানুষই ঢুকেছে। বাড়ির সীমানার বাইরেও ছাত্ররা অবস্থান নিয়েছে। গুমট একটা পরিবেশ। ফোন সেটটা একটু দূরেই। ব্যস্ততা থাকায় কেউ ফোনের কথা বঙ্গবন্ধুকে বলেননি। আবুল মনসুর আহমদ বারবার ফোনে না পেয়ে তাঁর ছেলেকে পাঠিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর বাসায়। বঙ্গবন্ধু মনসুর সাহেবকে ফোন দিলেন। তাঁদের কথোপকথন ছিল কিছুটা এমন—

আবুল মনসুর : পরিষদে যাইবা না কেন? পরিষদ তোমার। ইয়াহইয়া খান বরং বাইরের লোক। তোমার বাসায় তুমি যাইবা না?

বঙ্গবন্ধু : এত খুনের পরও পরিষদে যাইতে বলতেছেন? (হেসে উত্তর দিলেন)

আবুল মনসুর : তোমার ঘরে ডাকাতরা আইসা মানুষ খুন করলে কি তুমি ঘরে যাইবা না? ডাকাত তাড়াইতে হলে তো রক্তের ওপর পা দিয়াই যাইতে হবে।

বঙ্গবন্ধু : (শীতল কণ্ঠে) আজ ময়দানে ভাষণ দেব। শুইনেন সেই কথা।
 

সকাল সাড়ে ১০টা

ছাত্রদের দাবি, বঙ্গবন্ধু যেন স্বাধীনতার ডাক দেন। তাঁরা বেশ উত্তেজিত। অনেক ছাত্রনেতা বলছেন, যদি স্বাধীনতার ডাক না দেন, তবে বঙ্গবন্ধুকে ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হবে না। অন্যদিকে শহরের অনেক জায়গায়ই ছড়িয়ে গিয়েছে—বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেই মিলিটারিরা গুলি শুরু করবে। সেটা যদি ময়দান হয় তবুও গুলি করা হবে। একদিকে নিশ্চিত মৃত্যুর আশঙ্কা, অন্যদিকে ছাত্রসহ দেশের মানুষের চাপ। মানসিক অস্থিরতায় পড়ে যান বঙ্গবন্ধু। বাসায় যাঁরা আছেন তাঁদের নিয়েই পরামর্শ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তা ছাড়া দুপুর নাগাদ আবার রেসকোর্সে সভা। সময় একেবারেই নেই। ভাবলেন পাঠাগারেই বসা যাক।
 

সকাল ১১টা

দরজা বন্ধ নাকি খোলা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। বলা যায় রুদ্ধদ্বার বৈঠক। সঙ্গে আছেন তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও ড. কামাল হোসেন। সিদ্ধান্ত হলো, ছাত্রদের দাবি মানা হবে। বঙ্গবন্ধু প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন যাওয়ার জন্য।
 

দুপুর ১২টা

বঙ্গবন্ধু গোসল করে ফেলেছেন। আগে আগে বের হতে হবে। রাস্তায় ঝামেলায় পড়তে পারেন। হাসু (শেখ হাসিনা) বসেছেন মাথার কাছে। তিনি শুয়ে শুয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। এমন সময় এলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা। মোড়া টেনে কাছে বসলেন। হাসু তাঁর মায়ের এই স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত। বড় কিছু বলার আগে মা এভাবে বসেন। উঁচু উঁচু কথা বলেন নরম স্বরে। ব্যতিক্রম ঘটল না। তিনি বললেন, আজকে তুমি ভাষণ দিবা। তোমার মুখের ওপর সবাই তাকায়া আছে। মনের বিরুদ্ধে গিয়া এমন কিছু বইল না, যার জন্য পরে দেশের জন্য তুমি আফসোস করো।

বঙ্গবন্ধু কিছুই বললেন না। তবে ইতিহাস হয়ে গেল ফজিলাতুন্নেছার সেই কথাও। কারণ ৭ই মার্চের ভাষণের একটা বড় অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর কথাগুলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনেকবার বলেছেন তাঁর মায়ের আড়ালের অনুপ্রেরণার কথা। যে কথা বঙ্গবন্ধুকে আরো সাহসী করে তুলেছিল।

দুপুর আড়াইটা

বঙ্গবন্ধুর সহকারী হাজী মোহাম্মদ গোলাম মোরশেদ গাড়ি চালাচ্ছেন। চালকের পাশের আসনে বঙ্গবন্ধু। পেছনে আরো দুজন—মোস্তফা ও মহিউদ্দিন। সতর্কতার জন্য নিয়মিত যে রাস্তায় যেতেন, সেটা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে আজ যাওয়া হবে। রাজধানীর সাতরাস্তা এলাকা দিয়ে গাড়ি চালাতে বলেছেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। ঝিগাতলার কাছাকাছি আসার পর মোরশেদ কিছুটা কৌতূহলবশতই জিজ্ঞেস করে বসলেন—‘আজ ভাষণে কী বলবেন?

বঙ্গবন্ধুর উত্তর—‘দেখি আল্লাহ মুখ দিয়ে কী বের করে।’

রাত

৭ই মার্চের ভাষণের পরে ওইদিন রাতেই বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে খাবার খেতে বসেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু এখন থেকে একসঙ্গে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা, ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু গম্ভীর কণ্ঠে আরো বলেন, ‘আমার যা বলার ছিল আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যেকোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার করতে পারে। সে জন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে খাবে।’


তথ্যসূত্র : ইন্টারনেটে বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য ও অভিনয় কুমার দাশ সম্পাদিত সংকলন গ্রন্থ—‘বঙ্গবন্ধু’, আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুনের গ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’।

SUMMARY

2266-1.jpg