বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ: নতুন প্রজন্মের প্রেরণার উৎস

ড. কাজী এরতেজা হাসান   

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মাঠে তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ দেন। গোটা জাতির অধীর অপেক্ষায় ছিল এই ভাষণের জন্য। বঙ্গবন্ধু কি বলেন তার ভাষণে, তিনি কি স্বাধীনতার ডাক দেবেন? বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, তবে পাকিস্তান জান্তা সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথও খোলা রাখলেন। আর্ন্তজাতিক বিশ্বও জাতির জনকের ভাষণের অপেক্ষায় ছিলেন। তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে ছিলেন, 'কি বলেন বঙ্গবন্ধু?' বহির্বিশ্বও বুঝে গেল পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো আপোষ নয়। এবার বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করেই ছাড়বেন। তিনি বাঙালি জাতিকে এতদিন যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে আসছিলেন, এবার দেশের স্বাধীনতার লক্ষে সেই পথেই পা বাড়িয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তার ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীতার বীজ বপণ করে দিলেন। তিনি ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই মর্মবাণী বক্ষে ধারণ করে রেসকোর্সের মাঠে সমবেত জনতা জাতির জনকের ভাষণ শেষে ঘরে ফিরে গেলেন। তারা চূড়ান্ত ঘোষণা পেয়ে গেছেন। আর পেছনে ফিরে তাকার সময় নেই। যুদ্ধেই সব ফয়সালা হবে। 

ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমান নতুন প্রজন্মের কাছে এই ভাষণ প্রেরণার উৎস। যতদিন যাবে নতুন প্রজন্মের কাছে ৭ই মার্চের ভাষণ অনুপ্রেরণার সারথি হিসেবে কাজ করবে। তারা জাতির জনকের সোনার বাংলাকে বিশ্বের বুকে উজ্জ্বল-ভাস্কর হিসেবে তুলে ধরবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

৭ই মার্চের আগের দিন হরতাল পালনকালে সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে তারই নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসে ইতিপূর্বে বেতন দেওয়া হয়নি সেসব অফিস বেতন প্রদানের জন্য খোলা থাকে। দিন যতই গড়াচ্ছিল, অসহযোগ আন্দোলনের গন্তব্যও ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কি ভাষণ দেবেন তা শোনার জন্য সারা দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। জনসভাটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে তখন কারো সন্দেহ ছিল না। ৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু কি ঘোষণা দেবেন তা ঠিক করতে বঙ্গবন্ধু দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে চলেছেন।  

পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, যাই ঘটুক না কেন যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি, ততদিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব। এ সময় তিনি ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের পরেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। 

আলোচনা শেষে ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু বলেন, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না। ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মোটামুটি একটি কাঠামো স্থির করতে চায়।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এসেছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে। আন্দোলনের একপর্যায়ে মার্চের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। এরমধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়ানো হয়েছে। পাঠ করা হয়েছে স্বাধীনতার ইশতেহার এবং নির্বাচন করা হয়েছে জাতীয় সংগীত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রশ্নে বা আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত কবে দেবেন, সে জন্যই ছিল মানুষের অধীর অপেক্ষা। আন্দোলন এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় নিয়েই শেখ মুজিব ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্র সমাবেশে ৭ মার্চ ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন। একদিকে আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ব্যাপারে চাপ ছিল। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার দাবিতে ছাত্র নেতাদের একটা অংশ চাপ তৈরি করছিল। অন্যদিকে আলোচনার পথ খোলা রাখা হয়েছিল।

ফলে শেখ মুজিব ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে জাতীয় নেতা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেন। ৬ মার্চ রাতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমেদসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। সামরিক শাসন তুলে নেওয়া এবং সৈন্যদের ব্যারাকে ফেরত নেওয়াসহ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি চারটি শর্তের ব্যাপারেই শুধু বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। ভাষণ দিতে বাসা থেকে বেরোনোর সময় শেখ মুজিবকে তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন, ‘তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে।’ ৭ই মার্চের সেই ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন। ভাষণটি লিখিত ছিল না।

৭ই মার্চ সকাল থেকেই ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং ছাত্র নেতাদের ভিড়। দুপুর দুটার দিকে আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদসহ তরুণ নেতাকমীদের সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিব তার বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন জনসভার উদ্দেশে। এদিকে সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সে সময় রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। সেই রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অপেক্ষার পালা শেষ করে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি এবং হাতাকাটা কালো কোট পরে শেখ মুজিব উপস্থিত হয়েছিলেন। আগের নির্ধারিত রাস্তা বাদ দিয়ে ভিন্নপথে তাকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল। মঞ্চে সকাল থেকেই গণসংগীত চলছিল। সেদিন শেখ মুজিব সেই মঞ্চে একাই ভাষণ দিয়েছিলেন।

৭ই মার্চে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা আসতে পারে। মানুষের মধ্যে এ ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। প্রায় ১৮ মিনিটের এই ভাষণে সবদিকই উঠে এসেছিল। যাতে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা না হয়, সেজন্য তিনি চারটি শর্ত দিয়ে পাকিস্তান ভাঙার দায় নেননি। অন্যদিকে এই একটি ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন। 'স্বাধীনতার বীজ তিনি বপন করেছিলেন। এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকো'- এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একটা গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। লাঠি, ফেস্টুন হাতে লাখ লাখ মানুষ উত্তপ্ত স্লোগানে মুখরিত থাকলেও শেখ মুজিবের ভাষণের সময় সেখানে ছিল পিনপতন নিরবতা। ভাষণ শেষে আবার স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো।

৭ই মার্চের ভাষণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এখন আন্তর্জাতিক সম্পদ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এই ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ওই বছর ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংস্থাটির ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি’ (আইএসি)। ওইদিন প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতরে তৎকালীন মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এ সংক্রান্ত ঘোষণাটি দেন। বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার ঘোষণার’ স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছে প্রায় ৯ বছর। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের’ (বিএনসিইউ) ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভাষণটির স্বীকৃতি মেলে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৭ই মার্চের ভাষণের বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত ফাইলের সারসংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করেন ওই বছরের ৩০ মার্চ। এরপর শুরু হয় পরবর্তী কার্যক্রম। এসময় ইউনেস্কোর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনার ও কর্মশালায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব, মর্মার্থ ও তাৎপর্য তুলে ধরা হতে থাকে। এর অংশ হিসেবে ২০১১ সালে ইন্দোনেশিয়ায় আয়োজিত এক কর্মশালায় ভাষণটির ওপর একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন বিএনসিইউয়ের তৎকালীন প্রোগ্রাম অফিসার ও শিক্ষাবিদ রোকেয়া খাতুন।  ‘সেকেন্ড রিজিওনাল ট্রেনিং ওয়ার্কশপ অন দ্য ইউনেস্কো, মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডের’ বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে ওই কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। একটি জাদুকরী ভাষণ কীভাবে একটি দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারে ওই প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তা তুলে ধরা হয়। বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ভাষণের ওপর তৈরি প্রেজেনটেশনটি ব্যাপক প্রশংসা পায়। এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল প্যারিসে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত শহিদুল ইসলাম ইউনেস্কোতে ভাষণটির বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য আবেদন দাখিল করেন। আবেদন দাখিলের পর সেটি যায় এ সংক্রান্ত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটিতে। ২৪-২৭ অক্টোবর ওই কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সব প্রক্রিয়ার সম্পন্ন শেষে আসে কাঙ্ক্ষিত ঘোষণা। সাধারণত আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে, এমন বিষয়গুলোকেই বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্ট্রারের মেমোরিতে (মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) তালিকাভুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ১৮ মিনিট স্থায়ী এ ভাষণটিকে অনুবাদ করা হয়েছে বহু ভাষায়। নিউজ উইক সাময়িকী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

প্রসঙ্গত, ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির আগেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বৈশ্বিকভাবে একাডেমিক স্বীকৃতি পায়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরের সেরা ভাষণ নিয়ে ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ২২৩ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস- দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টোরি’ নামের ওই গ্রন্থ সংকলন করেছেন জ্যাকব এফ ফিল্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের ভাষণ দিয়ে শুরু করা সংকলনের শেষ ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের। বইটির ২০১ পৃষ্ঠায় ‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ দ্য স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শিরোনামে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি। বঙ্গবন্ধু যে কত বিচক্ষণ নেতা ছিলেন তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে তার ৭ মার্চের ভাষণ। ওই দিনের বক্তৃতায় জাতির পিতা মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পুরো বক্তৃতাটি জুড়ে ছিল আসন্ন জনযুদ্ধের রণকৌশল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। আবার তিনি চারটি শর্তারোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলেন না।

বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক নেতার আলোচিত ভাষণ রয়েছে। তবে কোনও নেতার ভাষণ এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে হয়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এই ভাষণটির মাধ্যমে তিনি নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন। ৭১-এর ৭ই মার্চে প্রদত্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, যা সমগ্র জাতির জন্য গৌরবের এবং আনন্দের।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ৭ই মার্চ এক অবিস্মরণীয় দিন। আমরা যারা স্বাধীনতার পরে জন্মগ্রহণ করেছি এ ভাষণটি সরাসরি দেখতে বা শুনতে পারিনি। কিন্তু আজও যখন এই ভাষণ শুনি, আমরা উজ্জীবিত হই। নব উদ্যমে এগিয়ে চলার প্রেরণা পাই। একজন নেতা কিভাবে একটি জাতিকে, একটি দেশকে একত্রিত করতে পারেন, একই দাবিতে সোচ্চার করতে পারেন- পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম দ্বিতীয় নজির নেই। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত হতাশা, শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে যে কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছিল; যে মহাকাব্য রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তার কোনো তুলনা নেই। আর সেজন্যই এই ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে, প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে, এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়।

ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখো মানুষের সামনে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এটাই ছিল বাঙালির ঐক্যের মূলমন্ত্র, স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’

৭ই মার্চের ভাষণ বর্তমান প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখায়- অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিবাদী হতে হয়, কীভাবে মাথানত না করে অবিচল থাকতে হয়, কিভাবে এগিয়ে যেতে হয়। ভাষণটি যতবার শোনা হয়, ততবারই নতুন ভাবনা তৈরি হয়। এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য একেকটি স্বতন্ত্র অর্থ বহন করে, নতুন বার্তা দেয়। ১৮ মিনিটের একটি ভাষণ একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই কালজয়ী ভাষণ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বিশ্বখ্যাত লেখক ও ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচ দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্টোরি’ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ স্থান পেয়েছে। অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারছে কঠিন পরিস্থিতিতে কীভাবে একটি ভাষণের মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কীভাবে শান্ত রেখেছিলেন কোটি মানুষকে, আবার সংগ্রামের প্রস্তুতির বার্তাও দিয়েছিলেন। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ না দিয়ে, উসকানি না দিয়ে কিভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয় সেই শিক্ষা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।

নতুন প্রজন্মকে শিখিয়েছেন কিভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়, অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হয়। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবিকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার এক মহাকাব্যিক রচনা এই ঐতিহাসিক ভাষণ। এই ভাষণের গল্প শুনেছে প্রথমে বাবা-মায়ের কাছে, তারপর শুনেছি স্কুলে পড়ার সময় ক্যাসেটে। ভাষণটি উজ্জীবিত করে, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। 

পরিশেষে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচার দীর্ঘকাল ধরে বিটিভিসহ গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা জিয়া। আজ এই তিনজনই আস্তাকুড়ে। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে লুপ্ত করতে পারেনি। বরং সেরা ভাষণ হিসেবে ইউনেস্কো পেয়েছে। 

লেখক: সম্পাদক-প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা

SUMMARY

2263-১.jpg