এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন
১৫০ মোগলটুলি। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হতো। ১৫০ মোগলটুলির মূল তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন শওকত আলী। এ প্রসঙ্গে বাহাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ১৫০ মোগলটুলি বিরোধী রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
কলকাতা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, জহিরুদ্দিন, নাঈমুদ্দীনের মতো নেতারা প্রথমে ১৫০ মোগলটুলিতেই জমায়েত হন। ঢাকা শহরের আদি অধিবাসী কলতাবাজার রোকনপুর এলাকার শওকত আলী ১৫০ মোগলটুলি পার্টি হাউসের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে রশীদ বিল্ডিংয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
ওই বৈঠকে শওকত আলী উপস্থিত ছিলেন এবং সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনুষ্ঠিত বৈঠক ও সমাবেশগুলোতে তিনি নিয়মিতভাবে যোগদান করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে রশীদ বিল্ডিংয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠা সংগ্রামের নেতাকর্মীদের যে মিলনমেলা বসত, সেখানে শওকত আলীর উপস্থিতি ছিল অনিবার্য।
ভাষা আন্দোলনের এ অফিসটি আক্রান্ত হয়েছিল ২০ জানুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে। এ সময় তিনি সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হন। অতঃপর মোহাম্মদ তোয়াহার উদ্যোগে ভাষা আন্দোলন অফিস ফজলুল হক হলে স্থানান্তরিত হলে (২৫ জানুয়ারি ১৯৪৮) তিনি সেখানেও নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
২ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কমরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে যে বৈঠক হয়, শওকত আলী সে বৈঠকে যোগদান করেন। অতঃপর সে দিন দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তাতে তিনি অন্যতম সদস্যরূপে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সংগ্রাম পরিষদ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। শওকত আলী হরতাল কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি পর্বের প্রতিটি স্তরে অংশগ্রহণ করেন। হরতাল চলাকালে যেসব নেতা ঢাকার রাজপথে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন শওকত আলী তাঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হন। ওইদিন হরতালে শওকত আলী পুলিশি নির্যাতনে আহত হওয়ার ফলে এক পর্যায়ে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রিকশাযোগে হাসপাতালে নিয়ে যান।
১২ মার্চ জেলখানায় বসেও শওকত আলী ও তার কারাবন্দি সাথীরা সরকারকে চরমপত্র প্রদান করেন। ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তির শর্তানুসারে ভাষা আন্দোলনের দায়ে বন্দিদের মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু শওকত আলীর বিরুদ্ধে আলাদা মামলা দায়ের করায় তাদের মুক্তি দিতে জেল কর্তৃপক্ষ অপারগতা প্রকাশ করে।
এ পর্যায়ে অন্য মুক্তিপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক এ দুজনকে ছাড়া জেলখানা ত্যাগ করবেন না বলে জানিয়ে দেন। এভাবে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অবশেষে শওকত আলীসহ সব ভাষাসৈনিককে কর্তৃপক্ষ মুক্তি দিতে বাধ্য হন। মুক্তি পেয়ে শওকত আলী ও শেখ মুজিবুর রহমান রাতে ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে ফিরে আসেন এবং পরদিন অর্থাৎ ১৬ ফেব্রুয়ারি আবারো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভা এবং ছাত্রসভার পর অ্যাসেমব্লি ভবন অভিমুখে মিছিল হয়, ওই জনসভা ও মিছিলে শওকত আলী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পিকেটিং করার এক পর্যায়ে পুলিশের লাঠিচার্জে তিনি আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং অজ্ঞান হয়ে যান। পরে পলাশী ব্যারাকের কর্মচারী ও সংগ্রামী জনতা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সর্বদলীয় বৈঠকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, শওকত আলী ওই সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে যে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল, শওকত আলী সে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি মিছিল, জনসভা, ছাত্রসভা, পিকেটিং কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন এবং বিভিন্ন স্থানে জনসভায় বক্তব্য রেখেছেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের অপরাধে শওকত আলী ২ মার্চ ১৯৫২ তারিখে গ্রেপ্তার হন।
পরবর্তীকালে জাতীয় ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির সঙ্গে শওকত আলীকে সম্পৃক্ত থাকতে দেখা যায়। তিনি জাতির গর্বিত সন্তানদের একজন। শওকত আলী ১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১১ সালে সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন এবং ঢাকায় তাঁর নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন : লেখকদ্বয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক।