যেভাবে মার্চের কৃষ্ণচূড়া রক্তছাপ শুরু


আহমদ রফিক

মার্চের শুরু। নামেই ফাল্গুন, অর্থাৎ বসন্তকাল। বাংলাদেশে মার্চ অগ্নিঝরা কৃষ্ণচূড়ার লালই নয় শুধু, রক্তঝরারও কাল বটে। সেটা অবশ্য শুরু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে—চক্রান্তে, ষড়যন্ত্রে, আপাত সংলাপে, রাজপথে ছাত্র-জনতার দৃপ্তপদভারে মিছিলে, বটতলার সভায়, অগ্নিঝরা স্বাধীনতার স্লোগানে—নানা দফার আড়ালে এক দফায় ১৯৭১ বসন্তে, অর্থাৎ মার্চে।
বর্ষ বিশেষে (১৯৭১) ঢাকার রাজপথে চলেছে মিছিল-স্লোগান উত্তপ্ত চড়া কণ্ঠের। একাত্তরের মার্চ রাজধানী ঢাকায় এমন এক ধারায় রাজপথে বিশেষ তাৎপর্যে, বিশেষ উত্তাপ ও উত্তেজনা ছড়িয়েছে ছাত্র-ছাত্রী, সাধারণ মানুষ, কৃষক-শ্রমিক জনতা। একদিকে সুশীতল ভবনকক্ষে রাজনৈতিক সংলাপ নানা দলের, বিশেষভাবে সামরিক সরকারের প্রতিনিধিদের ও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। সঙ্গে শ্রোতা বা বক্তা পশ্চিম পাকিস্তানি; বিশেষত ছোট-বড় রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে।

 শেষোক্ত গ্রুপ কখনো পূর্বোক্ত রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নেয়, কখনো নেয় না—চুপচাপ বিতর্কে অংশ নেয় নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে। এ রাজনৈতিক আসরে তথা আলাপচারিতায় প্রতিনায়ক করাচির রাজনৈতিক প্রধান পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চতুর রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো, যিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দাবা-পাশা খেলার একজন বড়সড় জুয়াড়ি। তিনিও আছেন আসরে, তবে দেরিতে। দড়ি টানাটানিতে ওস্তাদ এই ব্যক্তি একদিকে জনবান্ধব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল পিপিপির (পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি) নেতা, অন্যদিকে ধুরন্ধর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর শীর্ষ চতুর নেতাদের সঙ্গে গলাগলিতে ওস্তাদ। বিশেষ টোপ গিলিয়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়াকে লেজে খেলাচ্ছেন। তাঁর চাতুরীর কাছে সর্বমাত্রায় স্থূলকায় সামরিক প্রধান প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এক অসহায় জীব।
দুই.
১৯৭১-এর মার্চে এমনই এক পরিস্থিতি ছিল পাকিস্তানি রাজনীতির। জটিল, কুটিল, মাঝেমধ্যে দু-একটি স্বচ্ছতার আলোকবিন্দু—যে আলোকবিন্দুর আভাসে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন—প্রাদেশিক ও জাতীয় সংসদের এবং পাকিস্তানব্যাপী।
এ নির্বাচন নিয়ে হিসাবে অভাবিত রকম ভুল ছিল সামরিক শাসক ও সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় উগ্রপন্থী সমর নেতাদের। মনে হয় তেমনি ভুল ছিল সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থারও। কারো ধারণায় ছিল না পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। সে পরিবর্তন শুধু রাজনীতি-সচেতন শিক্ষিত ও নানা স্তরের মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেই নয়, পরিবর্তনটা দুই অর্থনীতি ও দুই পাকিস্তান ঘিরে। সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না পাকিস্তানি এলিট শ্রেণির—সামরিক ও বেসামরিক।
হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত বাঙালি মুসলমানের তথাকথিত পরিচিতি সংকটের (আইডেনটিটি ক্রাইসিস) এরই মধ্যে চরিত্রবদল ঘটে গেছে। সে চরিত্রবদল সম্পূর্ণ আরেক ভিন্ন ধারায়। সাম্প্রদায়িকতারও কিছুটা রংফেরা বাঙালি শিক্ষিত সমাজে। যেটাকে তখন মনে হয়েছিল প্রকৃত বাস্তব সত্য, পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে সেখানে মেকি ফল ফলেছে—থাক সেসব পরবর্তী সময়ের কথা।
আপাত বিচারে ‘বাঙালি’ এ শব্দটি ঘিরে একধরনের অদ্ভুত অবিশ্বাস্য সৌহার্দ্যপূর্ণ ঐক্য গড়ে উঠেছিল। সে ঐক্য একধরনের জাতীয়তাভিত্তিক, কারো ভাষায় শ্রেণি বিশেষের স্বার্থপরতাভিত্তিক মেকি জাতীয়তাবাদী চেতনাভিত্তিক। ধর্ম ও সম্প্রদায়ভিত্তিক সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী চেতনা আদপেই গড়ে ওঠেনি।
ধর্মীয় চেতনা, সম্প্রদায় চেতনা রাজনীতির সঙ্গে মিশ্র রূপ নিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত গড়ে তুলেছিল। আপাত বিচারে তা বুঝে উঠতে পারা যায়নি। ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় বিপুল আপন শক্তিতে রাজনীতি প্রভাবিত করেছে, পরবর্তী সময়ে তারাই দেশ শাসন করেছে সর্বস্তরে, তাদের শ্রেণিস্বার্থের ধারায়। সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু শব্দ দুটির বিভাজক চরিত্র লোপ পায়নি। অবস্থা পূর্ববৎ।
তিন.
বাঙালি মানসভুবনে এই মিশ্র চরিত্র পরিশেষে কী অবশেষ রূপ ধারণ করত তা এখন আর বলা সম্ভব নয়। কারণ এরই মধ্যে সামরিক শক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা পাকিস্তানকে ভিন্নপথে চালিত করতে শুরু করে। প্রাদেশিক শাসনের গুরুত্ব বিনষ্ট করে কেন্দ্রীয় শাসনের প্রাধান্য বড় হয়ে ওঠে—সেখানে সামরিক স্বার্থই বড় কথা, সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ এলিট শ্রেণি ও সামন্ত স্বার্থ।
তাই তাদের পক্ষে সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মান্য করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, মুখে গণতন্ত্রের বুলি যতই আওড়ানো হোক। সামরিক শক্তি—বিশেষত পাঞ্জাবি সামরিক শক্তির স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে, ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পেশাগত স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষা করে তবেই গণতন্ত্র, তবেই নির্বাচনের ফলাফল কার্যকর করার প্রশ্নটি বিবেচনায় রাখা সম্ভব। এমনই এক উদ্ভট হিসাব-নিকাশ ছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসকশক্তির।
তাই সম্ভবত নির্বাচনী ফলাফলের পর থেকে সামরিক রাজনীতির গভীর অঙ্গনে বিচার-বিশ্লেষণ চলতে থাকে, স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে বিছানো হতে থাকে ষড়যন্ত্রের জাল—বাইরে দাবা-পাশা খেলার নানামুখী চাল—ক্বচিৎ যুক্তিবাদী কথকতা, প্রায়ই মিঠে-মধুর কথকতার ফুলঝুরি—বাঙালি রাজনীতি এসব চালের গভীরতার সঙ্গে সত্যি বলতে কী এঁটে উঠতে পারেনি। তারা সব কিছুই সহজ-সরল অর্থে গ্রহণ করেছে। তাই তারা ইয়াহিয়ার এমন আপ্তবাক্য অনায়াসে বিশ্বাস করেছে যে নির্বাচনের ফলাফলমাফিক পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই প্রথম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করতে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করতে যাচ্ছে ইত্যাদি। বাঙালি উল্লাসে মাতোয়ারা। এই প্রথম তারা গোটা পাকিস্তান শাসন করতে যাচ্ছে।
এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা কি সম্ভব? বিশেষ করে যেখানে নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছয় দফা—অর্থাৎ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্ব নিয়ে। এ পর্বে বাঙালির রাজনৈতিক প্রতিভা যতটা মাঠে-ময়দানে কার্যকর জাদুকরী বক্তৃতা-বক্তব্যে, সন্দেহ নেই ততটা ছিল না কূটরাজনীতির মননশীলতায় ও তীক্ষ মেধায়। সহজ গ্রাম্য সারল্যের বৈশিষ্ট্য তার রাজনীতিকে বারবার প্রভাবিত করেছে। কথাটা অপ্রিয় শোনালেও অস্বীকার করা বোধ হয় কঠিন।
চার.
রমনার রাজপথে কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙের ছাপ শেষ পর্যন্ত তার স্বাপ্নিক আকাঙ্ক্ষা রক্ষা করতে পারেনি। ভোটবিপ্লব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হলেও তার ফলাফল বিপরীত ধারাকেই বেছে নেয়। সে ধারা ষড়যন্ত্রের চক্রান্তের শ্রেণিগত স্বার্থপরতার। সে শ্রেণি মূলত সামরিক গোত্রের ও বেসামরিক এলিটবর্গের অন্তর্গত।
অন্তর্গত চিন্তাটা হলো : না, বাঙালিকে বিশ্বাস করা যাবে না, বিশেষ করে যারা নানা স্তরে সম্পূর্ণ বিজাতীয়—ভাষা, সংস্কৃতি থেকে খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে। সর্বোপরি যে ভাষা-সংস্কৃতি অমুসলিম গোষ্ঠীর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এককথায় বিজাতীয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শর্তে রাজি না হওয়া পর্যন্ত তাদের হাতে ক্ষমতার দড়ি-রশি ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান তার ছয় দফায় অনড়—সেখানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রধান শর্ত বা ম্যান্ডেট, যা জনসমর্থনে সমৃদ্ধ। এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়। অতএব ষড়যন্ত্রের ছকটাই টিকে থাকে, অন্তর্গূঢ় পরিকল্পনা হিসেবে। চলতে থাকে সব ধরনের প্রস্তুতি—বাইরে সমঝোতার নামে সংলাপ— দলের সঙ্গে, ব্যক্তির সঙ্গে, যা এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দলীয় বিচারে রাজা-মহারাজারা এক এক করে আসছেন, যাচ্ছেন। বাইরের আলাপ আর ভেতরের গূঢ় পরিকল্পনা—দুয়ে আকাশ-পাতাল তফাত।
এভাবেই ঢাকায় কৃষ্ণচূড়ার রোমান্টিক মাস রক্তের ছোপে লাল হয়ে ওঠার পথ ধরে। পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সুবুদ্ধিসম্পন্ন ছোটখাটো দলগুলোর পক্ষে অন্তর্গত সত্য বুঝতে বাকি থাকে না। কিন্তু তারা অসহায়—তাদের কিছু করার ছিল না—তাৎপর্যপূর্ণ সতর্কবাণী উচ্চারণ ছাড়া এবং কিছু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দাবি তুলে ধরার বাইরে। বিষণ্ন মনে তারা বিদায় নেয় ঢাকা থেকে।
ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র গণহত্যার ছক তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। বাঙালি আন্দাজও করতে পারে না এমন একটি ভয়াবহ রাত তাদের উপহার দিতে যাচ্ছে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। শুরুটা অবশ্য সংলাপ স্থগিত করে বাঙালিকে প্রতিক্রিয়ায় উসকে দিয়ে। বাঙালি পাতা ফাঁদে পা দেয়। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া অসহযোগ আন্দোলনে। তাতেও রক্ত ঝরে উভয় পক্ষে। তৈরি হয় যুক্তি, প্রেক্ষাপট ২৫শে মার্চের গণহত্যার, সর্বোপরি একটি অসম যুদ্ধ বাঙালির মাথায় চাপিয়ে দেওয়ার লাখো প্রাণ হত্যার অজুহাত। মার্চ হয়ে ওঠে রক্তাক্ত কৃষ্ণচূড়ার মাস।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

SUMMARY

2257-1.jpg