শেখ রেহানা
১৫ আগস্ট আমাদের কাছে এক শোকাবহ স্মৃতি। বেদনার্ত অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আমাদের সব সময় কাটে। মা-বাবা, ভাই ও প্রিয়জন হারানোর এই দুঃখ-কষ্ট, অভাববোধ আমাদের সব সময় তাড়া করে। আমাদের আবেগাচ্ছাদিত করে রাখে।
১৯৭৫ থেকে লালন করে চলেছি আপনজনদের স্মৃতি। এক এক করে দিন কেটে যাচ্ছে, সময়ের পরিবর্তনে আমাদেরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। অনেক কথা শুনতে হয়েছে, অনেক কিছু উপলব্ধি করেছি এবং অনেক কিছু ভাবতেও শিখেছি।
রাজনীতির ভেতর জন্ম, আমাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে একটা জাতির পিতা হয়ে উঠলেন, তা তো আমি ঘনিষ্ঠভাবে শিশু বয়স থেকে দেখেছি। যখন তিনি কারাগারে রাজবন্দি, সাক্ষাতের দিনে মায়ের সঙ্গে আমরা যেতাম। কত কথা তাকে শোনাতাম। খবরের কাগজের অনেক সংবাদ পর্যন্ত। রাসেল তাকে বাড়ি আনার জন্য আবদার করত।
আব্বা আমাদের আদর করে লেখাপড়া করার কথা বলতেন কারাগার তার কীভাবে কাটে, এটা শোনার আমার আগ্রহ ছিল। তাই কত প্রশ্ন করতাম। তিনি হাসিমুখে সব উত্তর দিতেন। আব্বাকে আমি আশ্চর্য এক বিমুগ্ধ অনুভূতি দিয়ে দেখতাম। তার স্নেহ আদর আমার জীবনে এক মূল্যবান আশীর্বাদ।
বাড়িতে তাকে খুব কাছে পেতাম, তাই যেটুকু পেতাম প্রাণভরে দেখতাম, তার কথা শুনতাম, তার আদর স্নেহ স্পর্শের জন্য কাতর হয়ে থাকতাম। তার সেই বিশাল কক্ষে আমাদের ভাইবোনদের একটা গভীর আশ্রয় ছিল। এটাই ছিল যেন আমাদের পরম পাওয়া।
বাবার অবর্তমানে আমাদের আশ্রয়ে ছিলেন মা। মায়ের কাছ থেকে আমরা আব্বাকে চিনতে ও জানতে শিখি। আব্বার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি মায়ের অসম্ভব রকম সহযোগিতা ছিল সেটা তো তার জীবনের আর এক অধ্যায়। আমার মায়ের ধৈর্য, নীতিবোধ, পারিবারিক সংস্কার, ভালোবাসা ও মমত্ববোধ এক ভিন্ন মাত্রা। যার কোন তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার।
মহৎ ব্যক্তিত্বদের পেছনে এমনিভাবে মহীয়সীদের অবদান রয়ে যায়। আব্বার প্রতি মায়ের সযত্ন সহযোগিতা আমাদের দৃষ্টি এড়াত না। আমরা এভাবেই মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছি আব্বার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আদর্শবোধে উজ্জীবিত হয়েছি, ধীরে ধীরে নিজেদেরও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছি। দেশ ও দেশের মানুষ, সমাজ ও সমাজের ভালো-মন্দ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছি এবং পিতার আদর্শের অনুসারী হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরে গর্ববোধ করেছি।
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা গণহত্যা চালিয়ে এ দেশের মানুষকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। শেখ মুজিব সেই রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমাকে হাসু আপার সঙ্গে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। আমি তাকে ছেড়ে, মা ও রাসেলকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে চাইনি। মনে আছে, আমি খুব কাঁদছিলাম। আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন।
সারা রাত আমরা ঘুমুতে পারিনি। পরদিন খবর পাই, আব্বাকে রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সেই ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আব্বার কোন খবরই আমাদের জানতে দেয়া হয়নি। তিনি বেঁচে আছেন কি-না, সেটা জানতেও পারিনি। সে এক দুঃসহ বন্দিজীবনের স্মৃতি আমাদের।
বিবিসি দর্শক জরিপে তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তার প্রতি মানুষের ভালোবাসাই এ স্বীকৃতি। তার জীবনব্যাপী সংগ্রাম, আত্মত্যাগের সার্থক মূল্যায়ন দেশের মানুষ ও ইতিহাসবিদরা। যারা ইতিহাস বিকৃতিকারী তারা জানে না- মানুষের হৃদয় বড় কঠিন বড় সত্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম ছবি সেখান থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
আজ বার বার সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়। আমি হাসু আপার সঙ্গে জার্মানি গিয়েছিলাম। জার্মানি থেকে আব্বাকে ফোনে বলেছিলাম, আমি ঢাকায় ফিরে যাব। আব্বা কথাও দিলেন যে, ব্যবস্থা করতে বলবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। ভাগ্য আমাদের দু’বোনকে বাঁচিয়ে রাখল তাদের শোকভার বহন করতে। এমন নিষ্ঠুর হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পৃথিবীতে আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই, তবে কারবালার বিষাদময় হত্যার কথা আমরা সকলেই জানি।
এই শোকাবহ ঘটনার ভার বয়ে বেড়ানো বড় কষ্টের। বড় বেদনার। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তাদের আত্মার শান্তি হোক। বাংলার মানুষের জন্য আমার পিতা-মাতা ও ভাই-ভাবি, আত্মীয়-স্বজন জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, সেই বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটুক।
সব অমানিশার অন্ধকার মুছে গিয়ে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠুক। বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে আমরা যেন মুক্ত হয়ে বিশ্বে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারি।
আমি সব সময় এটা বিশ্বাস করি, জীবন অনেক ছোট। আমাদের ছোট্ট জীবনে এমন কিছু মহৎ কাজ করা উচিত যাতে সমাজের সবার কল্যাণ হয়।
(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বন্ধুবন্ধ গ্রন্থ থেকে নেয়া)