আবদুল্লাহ আল হারুন ১৯৩৩ সালের ১৪ মার্চ রাজউন থানার গহিরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামহ আবদুল লতিফ মাস্টার, বাবা আহমদ কবীর চৌধুরী, চাচা আহমদ ছগীর চৌধুরী ও লুৎফে আহমদ চৌধুরী তিনজনই ছিলেন তৎকালীন অনগ্রসর সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রসারে এবং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক জনহিতকর কর্মকাণ্ডে আজীবন নিবেদিত। পূর্ববাংলা জুড়ে ভাষা বিষয়ক আন্দোলনের হাওয়া বইতে শুরু করলে তিনিও অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে মানসিকভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। রাউজানে ছাত্রদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কাজে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪৮ সালে গহিরা স্কুলের পাশে ‘প্রগতি সংঘ’ নামক একটি লাইব্রেরি গঠন করেন, সেখানে তিনি ভাষার অধিকার বিষয়ে ছাত্র জনতাকে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি আরম্ভ করেন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রাম কলেজে ১ম বর্ষে ভর্তি হন। মূলত এই সময় থেকেই তিনি চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ভাষা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। সহজাত নেতৃত্বের গুণে হয়ে ওঠেন ছাত্র সমাজের অন্যতম মধ্যমণি। অত্যন্ত সাহসী, তুখোড় এই ছাত্রনেতা হয়ে ওঠেন ভাষা আন্দোলনের অনন্য নায়ক।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। প্রয়াত মৌলানা আহমেদুর রহমান আজমী ছিলেন সম্পাদক। মাহবুব-উল আলমকে আহ্বায়ক, এম এ আজিজ ও চৌধুরী হারুন-অর-রশীদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে চট্টগ্রাম জেলা ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এই পরিষদে ছাত্র জনতার সমন্বয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সমগ্র চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। আবদুল্লাহ আল হারুন এই পরিষদেরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে অবদান রাখেন।
১৯৫৬ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। জননেতা এম এ আজিজ ও জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তিনি নেতাকর্মীদের কাছে অত্যন্ত আপনজন হিসেবে পরিগণিত হন। নির্ভীক প্রজ্ঞাবান এই রাজনীতিবিদ তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণে একাধারে যেমন বঙ্গবন্ধু, এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ নেতার আস্থার পাত্র হয়ে ওঠেন তেমনিভাবে দলীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার ঘোষণা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চট্টগ্রাম থেকেই দেবেন বলে সিদ্ধান্ত দেন। ৬ দফার সমর্থনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের ৬ জন নেতার স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি তখন জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত হয়। যা জাতীয় রাজনীতিতে ভিন্নধর্মী এক গণজাগরণমূলক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
উল্লেখ্য, ওই বিবৃতিটি আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরীর স্বহস্তে লিখিত ছিল। বঙ্গবন্ধু লালদীঘির ময়দানে ৬ দফা ঘোষণা করেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী। ১৯৬২, ’৬৫, ’৬৯-এর প্রতিটি আন্দোলনে তিনি ধারাবাহিকভাবে অবদান রেখে গেছেন। ১৯৭০ সালে তিনি প্রাদেশিক গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করলে তিনি জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম আর সিদ্দিকীসহ আগরতলার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেন ও সাহায্যের আবেদন জানান। পরবর্তী সময় তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে আগরতলায় পার্লামেন্ট হাউসে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে সভা করেন, সেই সভায় মুজিবনগর সরকার গঠন বিষয়ক সিদ্ধান্ত হয়। দেশ স্বাধীন হলে তিনি দেশের প্রথম পার্লামেন্টে যোগ দেন ও বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচনা কমিটির সদস্য ছিলেন এবং সংবিধানে তাঁর স্বাক্ষর রয়েছে। পরবর্তী সময় তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলার বাকশালের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আবদুল্লাহ-আল-হারুন এগিয়ে না আসলে মাস্টারদা সূর্যসেনের বসতভিটা রক্ষা করা সম্ভব হতো না। তিনি সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন যার ডিজাইন করেন তাঁরই জামাতা স্থপতি সোহেল শাকুর। একটি হাসপাতালও গড়ে তোলেন সেখানে। স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ‘দৈনিক স্বাধীনতা’ (অধুনালুপ্ত)-এর সম্পাদক ছিলেন। পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে ১১ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম তিনি চট্টগ্রামের জন্য পৃথক শিক্ষা বোর্ড গঠনের দাবি তুলেছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ইউএসটিসিতে প্রোভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর অভিজাত ও পরিশীলিত চরিত্রের অধিকারী আবদুল্লাহ-আল-হারুন চৌধুরী ২০০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পবিত্র শবে মেরাজের রাত্রিতে আকস্মিকভাবে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।