দেবাশিস ভট্টাচার্য
তুমি কি কমিউনিস্ট?’’ তাঁর তীক্ষ্ণ প্রশ্নের মুখে ভয়ে জড়োসড়ো আমি। চাকরির পরীক্ষায় পাশ করে আনন্দবাজার পত্রিকায় শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিয়েছি। দূর থেকে তাঁকে শুধু আসতে-যেতে দেখেছি। সে দিনই প্রথম তাঁর ঘরে ডাক পড়েছিল। আমার লেখা একটি রিপোর্ট তখন তাঁর হাতে ধরা।
১৯৮০-র ১৬ ফেব্রুয়ারি। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছিল সে দিন। রটে গিয়েছিল, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে! ভরদুপুরে ঘন অন্ধকার। পথঘাট আক্ষরিক অর্থে জনমানবশূন্য। আমাকে বলা হয়েছিল, দিনটি সম্পর্কে বিশিষ্ট কয়েক জনের প্রতিক্রিয়া জেনে একটি রিপোর্ট লিখতে। সে দিন গ্রহণ সংক্রান্ত সব রিপোর্ট যুগ্ম-সম্পাদক সন্তোষবাবু নিজে দেখছিলেন। তাই আমাকেও তাঁর সামনে যেতে হয়েছিল।
দেখছিলাম, আমার লেখার এক জায়গায় এসে বার বার থেমে যাচ্ছেন। তার পরেই ওই প্রশ্ন। কখনও ছাত্র-রাজনীতির ছায়া মাড়াইনি। কী উত্তর দেব! সন্তোষ ঘোষ বললেন, ‘‘অবাক পৃথিবী সেলাম এই সব লিখেছ। তাই মনে হল তুমি বোধ হয় কমিউনিস্ট! এখনকার কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়েছ তো, তাই...।’’ বলতে বলতেই হাসি, ‘‘আমি কিন্তু লাইনগুলো কাটছি না। শুধু একটু মজা করলাম।’’ হেডিং লিখে দিলেন, ‘গ্রহণকে গ্রহণ নানা চোখে’।
সাংবাদিক সন্তোষবাবুর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করার সুযোগ আমার কার্যত হয়নি। কারণ আমরা যখন রিপোর্টার হয়ে যোগ দিয়েছি, তখন বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া তিনি সরাসরি বার্তা বিভাগের কাজে মাথা দিতেন না। পরে অবশ্য তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অন্য রকম কাজ করার, বলা ভাল, শেখার, অভিজ্ঞতা হয়েছে। তখন আমিও তাঁকে সহজ ভাবে ‘সন্তোষদা’ বলে ডাকতে পেরেছি। সে-সব কথা পরে।
তবে চাকরিতে ঢুকে অগ্রজ সহকর্মীদের মুখে তাঁর সম্পর্কে শুনতে শুনতে সন্তোষকুমার সম্বন্ধে ধারণা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সিনিয়রেরা বলতেন, সন্তোষবাবু অন্যের লেখা বড় একটা বদলাতেন না। ঘচ ঘচ করে কেটে দিতেন না। বরং কাঠামো বজায় রেখে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করতেন। আনন্দবাজারের প্রাক্তন রিপোর্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি, লেখার দু’চারটি শব্দ অদলবদল করে সন্তোষবাবু রিপোর্টের চেহারা পাল্টে দিতেন। কিন্তু কাঠামোটি থাকত অটুট। ফলে রিপোর্টারের মনে হত না যে, ওটা তাঁর লেখা নয়।
বাংলা সাংবাদিকতায় সন্তোষকুমার ঘোষের অবদান সম্পর্কে বলার কথা অনেক। গুরুত্বপূর্ণ হল, তিনি খবর লেখায় সাধুভাষার বদলে চলিত ভাষা চালু করেন। আগে আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশিত হত পুরো সাধুভাষায়। ১৯৫৮ সালে আনন্দবাজারে বার্তা-সম্পাদক হয়ে আসেন সন্তোষবাবু। ১৯৫১ থেকে দিল্লিতে আনন্দবাজার সংস্থারই ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে কাজ করেছেন।
আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দিয়ে সাংবাদিকতার ভাষা বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বদল আনেন সংবাদ পরিবেশনার আঙ্গিকেও। জোর দেন খবরকে রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দিকে। খাদ্য আন্দোলনই হোক, বা মাছের আকাল— নিত্য নতুন খবরকে দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চাইতেন। বাংলা কাগজকে সাজাতে শুরু করেন আধুনিক ধাঁচে। কোনও বিষয়ে ধারাবাহিক ভাবে রিপোর্ট লেখার সূত্রপাতও তাঁর হাতে।
বার্তা সম্পাদক হিসেবে তাঁর কার্যকাল ছিল দীর্ঘ। সেই সময় যাঁরা রিপোর্টার ছিলেন, তাঁদের অনেকেই নিজেদের সন্তোষবাবুর ‘হাতে তৈরি’ বলতে গর্ব অনুভব করেছেন। বরুণ সেনগুপ্ত থেকে শুরু করে অনেকেরই সাংবাদিকতার শুরু তাঁর কাছে। ‘কাজের’ লোক চিনে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। কাকে দিয়ে কোন কাজটি ভাল হবে, বুঝতেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আনন্দবাজার পত্রিকার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। পুরনোদের কাছে শুনেছি, সন্তোষবাবু সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারদের কাছে প্রতিটি খুঁটিনাটি জেনে নিজে রোজ খবরের অভিমুখ ঠিক করে দিতেন। তখন যাঁরা নিয়মিত ওই সংক্রাম্ত খবর করতেন সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁদের এক জন। সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করে সুখরঞ্জনবাবু বলেছেন, কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে যে দিন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা হয়, সে দিন খবরটি প্রেসে পাঠানোর সময় সন্তোষবাবু বলেছিলেন, ‘‘যেখানে ওই অনুষ্ঠান হয়েছে সেই জায়গাটির নাম (বৈদ্যনাথতলা) আমরা কাগজে ‘মুজিবনগর’ করে দেব।’’ পর দিন ‘মুজিবনগর’ থেকে স্বাধীন বাংলা সরকার গড়ার খবর বেরোলো আনন্দবাজারে। সেই প্রথম ‘মুজিবনগর’ নামটি মান্যতা পেল।
ভাষায় সাবলীলতা আনলেও শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুঁতখুঁতুনি ছিল সন্তোষবাবুর। চটুল, হালকা শব্দ লিখলে আপত্তি করতেন। এক বার একটি খবরের শিরোনামে ‘হাড্ডাহাড্ডি’ লেখা হয়েছিল বলে নিউজ় ডেস্কে কর্মরত এক বিশিষ্ট লেখককে বকুনি খেতেও দেখেছি। লেখার মধ্যে, বিশেষত শিরোনামে একটু কাব্যিক, রাবীন্দ্রিক ব্যঞ্জনা পছন্দ ছিল সন্তোষবাবুর। অনেকেরই মনে আছে মহাকাশে মানুষের প্রথম পদার্পণের পর দিন আনন্দবাজারের শিরোনাম: ‘মানুষ চূর্ণিল আজ নিজ মর্ত্যসীমা’।
সাংবাদিকতার নিজস্ব প্রয়োজনে শব্দ তৈরিও করে নিয়েছেন তিনি। যেমন, কাঁদানে গ্যাস। শব্দ ভেঙে, শব্দ গড়েও নিতেন খেলাচ্ছলে। শিক্ষানবিশ সাংবাদিকের পরীক্ষা দিয়ে ১৯৬৫ সালে নিউজ় ডেস্কে যোগ দিয়েছিলেন সমরজিৎ মিত্র। তাঁর মনে আছে, তখন যুক্তফ্রন্ট আমলে মন্ত্রিসভার টলমল অবস্থা চলছে। একের পর এক পদত্যাগ। রাতে প্রেসে নেমে পাতা তৈরি করছেন সন্তোষবাবু। সেটা লাইনো টাইপের যুগ। অক্ষরগুলি উল্টো করে কম্পোজ করা। তিনি কিন্তু অবলীলায় পড়তে পারতেন, যেন সোজা পাতায় ছাপা লেখা পড়ছেন। রিপোর্ট পড়ে হেডিং করলেন, ‘দিকে দিকে মন্ত্রীপাত’। সমরজিৎবাবুর খটকা লাগল, বানানটি ‘মন্ত্রিসভা’-র মতো হ্রস্ব ই-কার হওয়া উচিত নয় কি? বলেও ফেললেন সেটা। এক মুহূর্ত ভাবলেন সন্তোষবাবু। তার পর বললেন, ‘‘এত রাতে মীমাংসা করা যাবে না। তার চেয়ে হাইফেন করে দিই, মন্ত্রী-পাত।’’ তাঁর কর্মজীবনের একেবারে শেষ দিকে সন্তোষদা আমাকে কিছু দিন তাঁর ঘরে ডেকেছেন ডিকটেশন নেওয়ার জন্য। তখন হাত কাঁপে তাঁর। মুখে বলে যেতেন। কখনও সম্পাদকীয়, কখনও সাহিত্য-রচনা। টেবিলের উপর পানীয়ের গ্লাস। মাঝে মাঝে চুমুক। আর সেই সঙ্গেই মাথাব্যথার মলম নিয়ে কপালে ঘষতেন। সব মিলিয়ে একটি ঝাঁজালো বৃত্ত তৈরি হত।
দেখেছি, প্রথম লাইনটি লিখতে অনেকটা সময় নিতেন। পছন্দ না হলে নিজেই কম্পিত হাতে টেবিলের ও-পার থেকে হাত বাড়িয়ে পাতাটি ছিঁড়ে দিতেন। এক বার সম্পাদকীয় লেখার সময় বললেন, ‘‘আজ শব্দ নিয়ে খেলা করব। অনুপ্রাসের খেলা।’’
শুনেছিলাম তিনি নাকি খুব বদমেজাজি ছিলেন। একেবারে হাতে-পায়ে ‘কথা’ বলতেন। হবেও বা। আমি সেই সন্তোষ ঘোষকে দেখিনি। যাঁকে দেখেছি তিনি স্নেহ-প্রশ্রয়-আবেগ-বন্ধুতায় মাখামাখি এক নরম মনের মানুষ। গল্প করতেন অনেক রকম। তৃপ্তি কখন অতৃপ্তি হয়, মুক্তি কখন বন্ধনডোর হয়—সমবয়সির মতো ব্যাখ্যা করেছেন সেই সব।
ঘৃণ্য রাজনৈতিক চক্রান্তের কবলে পড়ে ১৯৮৪ সালে একান্ন দিন আনন্দবাজার পত্রিকার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কর্মস্থলে ঢুকতে পারিনি। যে দিন শেষ বিকেলে আদালতের নির্দেশে সবাই অফিসে ঢুকতে পারলাম, সেই রাতেই দ্রুত কাগজ বার করার ব্যবস্থা হল। অল্প পাতার কাগজ করতে হয়েছিল সে দিন। প্রথম পৃষ্ঠায় সন্তোষদার লেখা সম্পাদকীয়: ‘নমস্কার, অঙ্গীকার’। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘সত্য উদ্ঘাটন আর স্পষ্ট নির্ভীক ভাষায় তাহার পরিবেশন, যে ধর্ম জন্মাবধি এই পত্রিকার বৈশিষ্ট্য এবং অনন্য ভূষণ, কোনও হুমকিতেই তাহা স্খলিত হইবে না।...প্রতিদিন প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি শব্দে, প্রত্যেক অক্ষরে নিবেদিত হইবে এই অপরিবর্তন অর্ঘ্য।’’
সৌভাগ্য, সন্তোষকুমারের ওই সম্পাদকীয়টির শ্রুতিলিখনের সুযোগও আমিই পেয়েছিলাম।