আবদুল মান্নান
আজ দেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। শুরুতে ছাত্রলীগের গঠন থেকে শুরু করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ যেসব ছাত্রনেতা ও কর্মী এই সংগঠনটির সঙ্গে তার আদর্শকে ধারণ করেছেন, নির্লোভ থেকেছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকেছেন, তাদের সবাইকে অভিনন্দন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই দেশের রাজনীতি ও স্বাধীনতার ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একসময় যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা এখনও গর্ব করে বলেন তাদের সেই সম্পৃক্ততার কথা। সেটি ছাত্রলীগের সোনালি যুগ, বর্তমানে নানা কারণে তা ফিকে হয়ে এসেছে।
তরুণ শেখ মুজিব যিনি কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁর হাত ধরেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালে দেশ ভাগের এক বছরের কম সময়ের মাথায়। কলকাতার নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের আদর্শ ধারণ করতো। আর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জন্ম হয়েছিল মুসলিম লীগের আদর্শের বিপরীত। মুসলিম ছাত্রলীগের জন্মও সহজ ছিল না, কারণ শুরুতে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের নেতারাই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উত্তরসূরি হতে চাইলেন। ১৯৪৪ সালের পর নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের আর কোনও কাউন্সিল হয়নি। সেই কাউন্সিলে শাহ আজিজুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি নতুন গঠিত ছাত্রলীগের ওই পদে থাকতে চাইলেন। বাদ সাধলেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব। সঙ্গে পেলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ ছাত্রনেতাকে। এদের নিয়েই তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব মিলিত হয়েছিলেন ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে। সভায় কনভেনর নিযুক্ত হয়েছিলেন রাজশাহীর নইমউদ্দিন আহমেদ। বিভিন্ন জেলা থেকে ১৫ জন সদস্য নেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শেখ মুজিব (জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু), আবদুর রহমান চৌধুরী (পরে বিচারপতি), অলি আহাদ (রাজনীতিবিদ), শেখ আবদুল আজিজ (রাজনীতিবিদ), আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী (বিচারপতি) প্রমুখ। এই সময় তরুণ শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। নামের সঙ্গে মুসলিম শব্দটি থাকায় জোর আপত্তি জানান অলি আহাদ। তিনি বলেন, এই শব্দটি থাকলে সংগঠনটি একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন হবে। তাঁকে অনেক বুঝানো হলো সময় হলে এই শব্দটি তুলে দেওয়া হবে। তাঁর ব্যারিস্টার কন্যা বর্তমানে বিএনপি থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য। ১৯৫৩ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। শুরুতে ছাত্রলীগের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয় ১৫০ নম্বর মোগলটুলী। এটি ছিল যুবলীগের অফিস। একসময় এই অফিস থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হয়েছিল মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ।
পূর্ব বাংলায় ছাত্রলীগের অভিষেক হয় ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এরপর পূর্ব বাংলায় যত গণআন্দোলন হয়েছে, তার সবক’টির সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। এরমধ্যে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে গণআজাদী লীগ, তমদ্দুন মজলিস ও স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররাও।
ছাত্রলীগের একটি নতুন সোনালি অধ্যায় শুরু হয়েছিল ঊনসত্তরের গণআন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এই আন্দোলনটি মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন হিসেবে ও রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে। আন্দোলনটির সূত্রপাত করেছিলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররা। এর পরপরই তা পূর্ব বঙ্গের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় জেনারেল আইয়ুব খান তাঁর ক্ষমতা দখলের এক দশক পালন করছিলেন। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘উন্নয়নের এক দশক’ (Decade of Development)। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে তোফায়েল আহমদ সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন নাজিম কামরান চৌধুরী। তখন ডাকসু’র কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হতেন বিভিন্ন হল থেকে রোটেশনের ভিত্তিতে। এই আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব ছিলেন কারাগারে। পাকিস্তান সরকার এই আন্দোলন দমন করতে অনেকটা ব্যর্থ। অনেকের মতে, আইয়ুব খানের বিদায় অনেকটা সময়ের ব্যাপার। ঠিক এই সময় ১৯৬৮ সালের ২৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার এক প্রেসনোটের মাধ্যমে ঘোষণা করে শেখ মুজিব ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা ও দলীয় কিছু নেতাকে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য একটি ষড়যন্ত্র করেছেন। মামলাটির নাম দেওয়া হয় রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য। তবে সাধারণের কাছে এই মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে অধিক পরিচিত। ৩৫ জনের মধ্যে যে ক’জন কারাগারের বাইরে ছিল তাদের দ্রুত গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তান সরকারের এই হঠকারী কর্মকাণ্ড পূর্ব বাংলার রাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দেয়। তখন ছাত্রদের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। নেতৃত্বে ডাকসু ও অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন।
সত্তরের নির্বাচনে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়ী করানোর জন্য এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন জেলায় তারা জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থীদের পক্ষে রাতের ঘুম হারাম করে গ্রামগঞ্জে প্রচারণা চালায়, হাতে লিখে পোস্টার বিভিন্ন জায়গায় লাগায়, অনেক জায়গায় নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে অথবা দুই টাকা পাঁচ টাকা চাঁদা তুলে রিকশা ও ঘোড়ার গাড়িতে মাইক লাগিয়ে নৌকা মার্কার পক্ষে প্রচারণা চালায়। রাতের বেলায় মিছিল বের করে। হাতে টিনের চোঙা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে স্লোগান দেয়। আজকের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তা কল্পনাও করতে পারবে না সেই সময়কার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ত্যাগ আর নিষ্ঠার কথা। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় শুধু সিরাজুল আলম খানের একটা ভেসপা স্কুটার ছিল। বাকিরা রিকশায় অথবা হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অথবা পল্টন ময়দানের জনসভায় যোগ দিতেন। বর্তমানে যারা রাজনীতিতে সক্রিয় বা অন্যান্য পেশায় তাদের মধ্যে তোফায়েল আহমদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, খালেদ মোহাম্মদ আলি, আবদুর রউফ, আ স ম আবদুর রব, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, ফরিদুন নাহার লাইলি, ওবায়দুল কাদের, মাইনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, এনামুল হক শামীম, বাহাদুর ব্যাপারি, সুভাষ সিংহ রায়সহ অনেকেই ছাত্রলীগের সৃষ্টি। এদের মধ্যে পরবর্তীকালে হয়তো বিভিন্ন জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শনে দীক্ষা নিয়েছেন। বিএনপি’র অন্যতম নেতা ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুহসীন হল ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচিত সহ-সভাপতি। তখন তিনি হল পর্যায়ের ছাত্রলীগের বড় নেতা। ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে তিনিই ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত এই হলের একমাত্র প্রার্থী। বাকিরা মোনায়েম খানের পেটোয়া বাহিনী এনএসএফ-এর হাতে নির্যাতিত হয়ে ক্যাম্পাসছাড়া। বাদ ছিল শুধু ইকবাল হল (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। কারণ, এই হলটি সব সময় ছাত্রলীগের একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল।
দেশ স্বাধীন হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যুদ্ধের ময়দান থেকে বিজয়ের বেশে পুনরায় ক্লাসে ফিরে এসেছিলেন। তখন তাঁরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে একেকজন মহানায়ক। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কারও বিরুদ্ধে লুটপাট, চাঁদাবাজি বা অন্য কোনও বড় ধরনের অপরাধের কথা শোনা যায়নি। ছাত্রলীগের সেই সোনালি অতীত এরশাদ পতনের পর ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করে। একশ্রেণির নেতাকর্মীকে অর্থলোভ গ্রাস করে। অনেকটা রাতারাতি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চেনা ছাত্রলীগকে অচেনা মনে হয়। পরিস্থিতি এতই খারাপ হওয়া শুরু করে, একসময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সকল দায়িত্ব হতে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। একবার ছাত্রলীগের কিছু কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে একটি জাতীয় দৈনিকে আমি একটা কলাম লিখেছিলাম। সেই লেখার প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ আমাকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। অথচ এই সেই বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে কোনও ছাত্রসংগঠন প্রবেশ করতে পারত না, কারণ এই ক্যাম্পাস দীর্ঘদিন ধরে একটি মৌলবাদী ছাত্রসংগঠন সন্ত্রাস সৃষ্টি করে দখলে রেখেছিল। ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমাকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। দায়িত্ব নিয়েই আমি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই ক্যাম্পাস সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম।
ছাত্রলীগের ৭২তম জন্মদিনে এই সংগঠনের অগুনতি নেতাকর্মীকে উষ্ণ অভিনন্দন। প্রত্যাশা, ফিরে আসুক ছাত্রলীগের সোনালি দিনের সেই অতীত, আমাদের ছাত্রজীবনের ছাত্রলীগ। নেতাকর্মীরা গর্ব করে বলতে পারুক−‘আমি ছাত্রলীগ করি’।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক।