তোফায়েল আহমেদ
ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের জাতীয় জীবনে সবিশেষ গুরুত্ববহ। '৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে বাংলার সংগ্রামী ছাত্রসমাজ রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে। আর '৬৯-এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা দেশব্যাপী তুমুল গণআন্দোলন সংঘটিত করে দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার 'ভোটাধিকার' অর্জন এবং প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারামুক্ত করে। সত্যিকার অর্থেই '৫২-এর রক্তধারা '৬৯-এর রক্তস্রোতে মিশে '৭১-এ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উন্মেষ ঘটায়। বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এ এক ঐতিহাসিক পরম্পরা।
'৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ডাকসু' কার্যালয়ে চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে আমার সভাপতিত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুর রউফ (প্রয়াত) ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক (প্রয়াত) ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা; ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ; এবং এনএসএফ একাংশের সভাপতি ইব্রাহিম খলিল (প্রয়াত) ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সী, ডাকসু জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী ও আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি। ১০ জন ছাত্রনেতার উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম 'কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে ছয় দফা দাবি আদায় ও বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে ছয় দফাকে দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন সমেত ১১ দফার ৩ নম্বর দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করি। বাস্তবত ১১ দফা ছিল ৬ দফারই সম্প্রসারিত রূপ, যাতে ধারিত হয়েছিল বাংলার গণমানুষের জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি গণআন্দোলন-গণবিস্টেম্ফারণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় গণঅভ্যুত্থান। ২৪ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ১১ দফার প্রতি ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীসহ বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলাম। এরই প্রতিফলন দেখতে পাই আমাদের ঘোষণার স্বতঃস্ম্ফূর্ত বাস্তবায়নে। আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম গুলিস্তানে; এখন যেখানে মহানগর নাট্যমঞ্চ তার পাশের পার্কটির নাম হবে শহীদ মতিউরের নামে, 'মতিউর পার্ক'; যেটি ছিল আইয়ুব গেট, সেটির নামকরণ করেছি শহীদ আসাদের নামে, 'আসাদ গেট'; আর দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ঘোষিত আইয়ুবনগরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলার কৃষকদরদি নেতা শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের নামে, 'শেরেবাংলা নগর'। মুক্তিকামী বিক্ষুুব্ধ জনতা স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে নামগুলো পাল্টে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। পরম শ্রদ্ধাভরে এসব স্থানে শহীদদের নামাঙ্কিত ফলক স্থাপন করা হয়।
'৬৯-এর গণআন্দোলনে শহীদ আসাদ-মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীর-সার্জেন্ট জহুরুল হক-ড. শামসুজ্জোহাসহ সব শহীদের রক্তের শপথ নিয়ে বলেছিলাম- 'এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না।' শহীদদের আত্মদান বৃথা যায়নি- পরবর্তী ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে। তাদের আত্মত্যাগের ধারাবাহিকতায় আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন এবং আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন; পল্টনে জীবনের প্রথম জনসভা। এদিনেই আমরা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১০ জন ছাত্রনেতা লাখ লাখ মানুষের সামনে 'জীবনের বিনিময়ে ১১ দফা দাবি আদায়ের শপথ গ্রহণ' করি। ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে 'শপথ দিবস' পালিত হয়। জনসভা তো নয়, যেন বিশাল এক গণমহাসমুদ্র! চারদিক কানায় কানায় পরিপূর্ণ। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সেদিনের সুবিশাল পল্টন ময়দান সংগ্রামী জনতাকে ধারণ করতে পারেনি।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক এবং সভার সভাপতি হিসেবে পিনপতন নীরবতার মধ্যে একটানা ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করি। সেদিনের বক্তৃতায় যা বলেছিলাম, পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে তা প্রকাশ হয়েছিল। বক্তৃতার শেষে সমবেত জনতার তুমুল গর্জনের সঙ্গে বজ্রকণ্ঠে স্লোগান তুলি- 'শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করব/ শপথ নিলাম শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করব।' ৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণআন্দোলন সমগ্র জাতিকে উজ্জীবিত করে ৯ ফেব্রুয়ারি এক মোহনায় শামিল করেছিল। ভাবতে আজ কত ভালো লাগে, ঐতিহাসিক শপথ দিবসের এই স্লোগানের দুটি লক্ষ্যই সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছি। সোনার বাংলার ৩৯ জন সোনার সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে '৬৯-এর ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করে; '৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে গণরায় নিয়ে; '৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক মানুষের সুমহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করে সেদিনের সেই শপথবাক্য আমরা বাস্তবায়ন করেছি।
স্বৈর শাসকের শত উস্কানি সত্ত্বেও আমরা নৈরাজ্যের পথে যাইনি। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলন করেছি। নিজেদের মধ্যে মত ও পথের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আমরা সেদিন ১১ দফা দাবি আদায় প্রশ্নে ছিলাম ঐক্যবদ্ধ। দলীয় আদর্শ নিয়ে পরস্পরের মধ্যে মতদ্বৈধতা থাকলেও আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক ছিল চমৎকার। এক টেবিলে বসেই আহার করতাম। বিপদে-আপদে একে অপরের খবর নিতাম এবং হৃদ্যতাপূর্ণ এই সম্পর্কই ছিল আমাদের আন্দোলনের ভিত্তি। '৬৯-এর গণআন্দোলনে আমাদের সংগ্রামী ভূমিকা, কর্মসূচি পালনে নিষ্ঠা, সততা ও জনদরদি আবেদন মানুষের হৃদয়ে এতটাই সাড়া জাগিয়েছিল যে, বাংলার মানুষ আমাদের মাথায় তুলে নিয়েছিল। আজ যখন ইতিহাসের সেই গৌরবোজ্জ্বল ৯ ফেব্রুয়ারি 'শপথ দিবস'-এর সোনালি দিনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন ফেলে আসা সংগ্রামী দিনগুলোর জ্যোতির্ময় বৈপ্লবিক বহিঃপ্রকাশ মনে হয় অনন্যসাধারণ!
আজ সেই সোনালি অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হয়, কী করে এটা সম্ভব হলো! তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিচার চলছে। 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য' অর্থাৎ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বলে যে মামলাকে অভিহিত করা হয়েছিল, সেই মামলার বিচার চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ফাঁসির মঞ্চে। আমরা জাগ্রত ছাত্রসমাজ শুধু ঐক্যবদ্ধ হইনি, গোটা জাতিকে আমরা ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা যখন পল্টনে মিটিং করি, তখন সচিবালয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস বন্ধ করে এই পল্টনের জনসভায় ছুটে আসতেন। সেদিনের জনসভাগুলো শুধু পল্টন ময়দানেই সীমাবদ্ধ থাকত না; আশপাশের এলাকাসহ সমগ্র মতিঝিল, শাপলা চত্বর থাকত কানায় কানায় পরিপূর্ণ।
অমর একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক দিনে পল্টন ময়দানে লাখ লাখ লোকের সামনে যখন প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত মুক্তিদানের আলটিমেটাম দিয়েছিলাম, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রিয় নেতাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে গণসংবর্ধনায় কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষে কৃতজ্ঞ চিত্তে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম। ৯ ফেব্রুয়ারির পর আমাদের জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেনন, ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকীসহ যারা কারাগারে বন্দি ছিলেন, তারা সবাই এবং পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে মণি সিংহ, মতিয়া চৌধুরীসহ সব রাজবন্দি মুক্তিলাভ করেন। আগরতলা মামলায় ৩৫ জন আসামি ছিলেন। তন্মধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হক শহীদ হন। বাকি ৩৪ জনকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে স্বৈর শাসক বাধ্য হয়। তখন কারাগার রাজবন্দিশূন্য। সেই দিনগুলোর কথা আজ আরও বেশি মনে পড়ে।
৯ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন শুধু ১১ দফার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেদিন আন্দোলন এক দফায় চলে যায়- শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া আমরা ঘরে ফিরব না। ভাবতে আজ ভালো লাগে, প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া আমরা ঘরে ফিরিনি। যে বক্তৃতা আমরা করেছিলাম- সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণীত হতে হবে; সেই কথাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত গণসংবর্ধনায় বক্তৃতায় বলেছিলেন। যার জন্য ১৯৭০ সালে সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যার কারণে আমরা মেজরিটি হতে পেরেছিলাম এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পেরেছিলেন।
প্রতি বছর এই দিনগুলো আমাদের জীবনে ফিরে আসে ঠিকই, কিন্তু কেন জানি আমরা ১৯৬৯-এর ঐতিহাসিক গণআন্দোলনকে সেইভাবে স্মরণ করতে চাই না! কিন্তু আনন্দের বিষয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রতিটি মিটিংয়ে, আমি তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে যেতাম; যখন বক্তৃতা করতেন, সেই '৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, '৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান- এই কথাগুলো তিনি বলতেন। এমনকি ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বক্তৃতায়ও তিনি ১৯৬৯-এর সেই গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। আমার লাইব্রেরি রুমে বসে '৬৯-এর সেই দিনগুলোর ছবি ও পত্রিকার পাতাজুড়ে প্রতিবেদনগুলো যখন দেখি, তখন একদিকে আনন্দে বুক ভরে যায় যে, একদিন আমরা এসব গৌরবোজ্জ্বল দিন সৃষ্টি করেছিলাম। অপরদিকে মনে কষ্ট লাগে, যেভাবে এই দিনগুলো পালন করা উচিত, সেভাবে আমরা পালন করি না।
আওয়ামী লীগ নেতা; সভাপতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ
tofailahmed69@gmail.com