ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী
১৭ মার্চ ১৯২০ বুধবার সবে ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার মধুমতী নদীর পাড়ে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ বংশের পরিত্যক্ত 'বিষাক্ত সর্পকুল আশ্রিত দালানের' পাশের টিনের বাড়ি থেকে এক বয়স্ক গ্রাম্য দাই হঠাৎ ছুটে এসে বললেন, 'লুৎফর, তোর একটা খোকা হয়েছে, আজান দে।' শেখ লুৎফর রহমানের চাচাতো ভাই খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদের কিশোর ছেলে শেখ মোশাররফ হোসেন আজান দিয়ে সবাইকে জানাল খুশির খবর। তার ভাবি সায়েরা খাতুন দুই কন্যার পর প্রথম পুত্রসন্তান প্রসব করেছেন। নবজাতকের নাম স্থির হলো ফরিদপুরের গৌরব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মাস্টার্সে অঙ্কের রেকর্ড ভঙ্গকারী অবিশ্বাস্য মেধার অধিকারী মুসলমান ছাত্র আবুল ফজল মুজিবুর রহমানের নামানুসারে শেখ মুজিবুর রহমান। এ এফ মুজিবুর রহমানের অঙ্কের রেকর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও বহাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্মিত উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির সাহায্য ও সহযোগিতায় এ এফ মুজিবুর রহমান ১৯১৯ সালে ইংল্যান্ড যান এবং আইসিএস পরীক্ষায় সফল হয়ে পরের বছর ভারতে ফিরে আসেন।
১৪ বছর বয়সে সুস্থ-সবল কিশোর মুজিবুরের পা হঠাৎ ফুলে যেতে থাকে। প্রায়ই বমি বমি ভাব ও শরীরে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি হয়। হাতে-পায়ে বোধশক্তি হ্রাস পায় এবং হূৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যায়। প্রাণচঞ্চল ফুটবল মাঠের চমক মুজিব ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে খেলাধুলা ও পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। শয্যাশায়ী মুজিবুরের অনেক পরীক্ষা করে কলকাতার ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য এবং ডা. এ কে রায় চৌধুরী রোগ নির্ণয় করেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদ্বয় স্থির করলেন, আতপ চালের পায়েশের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণের নিমিত্তে এবং খাদ্যে ভিটামিন বি-১ অভাবজনিত কারণে বেরি বেরি রোগ হয়েছে। ভিটামিন ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা শুরু হলো এবং খাদ্য স্থির হলো নিয়মিত কেবল ঢেঁকিভাঙা চালের ভাত, ছোট মাছ এবং প্রচুর মটরশুঁটি ও শাকসবজি। বেরি বেরি রোগ থেকে কিশোর মুজিব সুস্থ হলো; কিন্তু চোখের দৃষ্টি বিভ্রাট হলো, গ্লুকোমা নির্ণীত হলো, অপারেশন করলেন কলকাতার প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি আহমেদ। ১৬ বছর বয়স থেকে কিশোর মুজিবুরের চশমা পরা। তিন বছর খেলাধুলা ও পড়াশোনা বন্ধ থাকল। কয়েক বছর ভালো কাটলেও ম্যাট্রিক পরীক্ষার ঠিক একদিন পূর্বে ভয়ানক জ্বর হলো ১০৪ ডিগ্রি, মামস্ হয়ে গলা ফুলে গেল, অসহনীয় মাথাব্যথা ও চক্ষু জ্বালা; পরীক্ষা খারাপ হলো। কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৪৫ সালে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে তরুণ শেখ মুজিব বুকে, পেটে ও সমস্ত শরীরে অসহ্য বেদনায় আক্রান্ত হন, তিন দিন পায়খানা হয়নি। হেকিম আজমল খান বিদ্যালয়ের একজন হেকিমের জোলাপে দ্রুত সুস্থ হয়ে কলকাতায় বেকার হোস্টেলে ফিরে আসেন। এসব বিবরণ আমরা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পাই।
১৯৩৮ সালে ছাত্রাবস্থায় স্থানীয় হিন্দুদের চক্রান্তে পাড়ার হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে মারধরের অভিযোগে তরুণ মুজিব গ্রেপ্তার হন। সাত দিন হাজতবাস করে, ১৫শ' টাকা জরিমানা পরিশোধ করে মুক্তি লাভ করেন।
ভারত বিভাগের পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র হোস্টেলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শেখ মুজিব জড়িত হয়ে পড়েন। কলকাতার লালবাজার থানা থেকে আসা ঢাকার লালবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ হুমায়ুন মুর্শেদ চৌধুরীর সঙ্গে ১৯৪৮ সালের শুরুতে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ। প্রথম দেখায় তরুণ রুগ্ণ অথচ আকর্ষণীয় শেখ মুজিব সম্পর্কে ওসি সাহেবের পর্যবেক্ষণ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য :'তুমি মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনীতিতে জড়িও না, পড়াশোনা শেষ করো, তুমি পূর্ব পাকিস্তানকে অনেক কিছু দেবে, তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত, পুলিশ এড়িয়ে চলো।' তেজোদীপ্ত শেখ মুজিব ওসি সাহেবের পরামর্শ আমলে নেননি। তবে ওসি সাহেবের পর্যবেক্ষণ পরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল, শেখ মুজিব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ হিসেবে। রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধু প্রথম জেলে যান ১৪ মার্চ ১৯৪৮ সালে এবং মুক্তিলাভ করেন চার দিন পর। ১৯৭১ সালে সাড়ে ৯ মাস পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলে বন্দি থাকেন; মুক্তিলাভ করেন ৮ জানুয়ারি ১৯৭২। তার আগে ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় আট বছর কারাবন্দি ছিলেন। কারাজীবনের বিভিন্ন সময়ে তার অসুস্থতার বিবরণ আছে 'কারাজীবনের রোজনামচা' বইয়ে।
১৯৫০ সালে গোপালগঞ্জ জেলে থাকাকালে দুর্বল হার্ট, চক্ষু যন্ত্রণা ও বাঁ পায়ে রিউমেটিক ব্যথা হয়, ভীষণ জ্বর ও মাথাব্যথা এবং বুকে ব্যথা। ধরা পড়ে খুলনা জেলে, চোখের অসুখও বাড়ে। ভালো চিকিৎসার দাবিতে ফরিদপুর জেলে শেখ মুজিব অনশন করেন। জেল চিকিৎসকরা জোর করে টিউব ঢুকিয়ে তরল খাবার প্রবেশ করালে নাকে ক্ষত সৃষ্টি হয়; হার্টের অবস্থা খারাপ হয়, পালপিটিশন বাড়ে এবং নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ১৯৬৬ সালে জেলে থাকাকালে শেখ মুজিব ভোগেন অনিদ্রা ও ক্ষুধামান্দ্যে। ২৯ জুন ১৯৬৬ সকালে হঠাৎ পায়খানার দ্বার দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরে এবং পাইলস ও গ্যাস্ট্রিকের পুনরাবির্ভাব হয়। সঙ্গে মাথা ভার, ব্যাপক বদহজম ও খাওয়ায় অনিচ্ছা। একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং নির্জন কারাবাসেও শেখ মুজিবের মনে দৃঢ়তা অটল- 'আমাকে বাঁচতে হবে, অনেক কাজ বাকি আছে।'
জুলাই মাসে পাইলস কমে; কিন্তু পেট মাঝেমধ্যে খারাপ হয়, আমাশয় বাড়ে, অনিদ্রা সমস্যা বাড়ায়। যোগ হয় পিঠ থেকে কোমর পর্যন্ত ভয়ানক ব্যথা। পরের বছর প্রায়ই অসহ্য মাথাব্যথা ও চোখের ব্যথায় ভোগেন, সারিডন ট্যাবলেট খেয়ে কিছুটা ভালো থাকেন; কিন্তু ওজন কমে এবং পায়খানার দ্বার দিয়ে রক্ত পড়ে, দুর্বলতা বাড়ে। স্বাধীনতার পর তিনি 'সারিডন' খাওয়া বন্ধ করেছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম, সারিডনে ক্ষতিকর ফিনাসিটিন আছে; তাই ব্রিটেনে এটা নিষিদ্ধ। পরে তিনি ব্যথা নিরাময়ের জন্য রেকিট কোলম্যান কোম্পানির এসপ্রো খেতেন। এসপ্রোর মূল উপাদান অ্যাসপিরিন।
ফরিদপুর, খুলনা ও ঢাকার জেলে থাকাকালে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলী তার চিকিৎসা করেছেন। গাঙ্গুলীর পিতামহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভারত বিভাগের পূর্বে ডা. মোহাম্মদ হোসেন রাঁচি মানসিক হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। তিনি সিভিল সার্জন থাকাকালে শেখ মুজিবের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে রেফার করেছিলেন। সেখানে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন এস এ লস্কর এবং মেডিসিন অধ্যাপক এ কে সামসুদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবের প্রায় এক মাস চিকিৎসা করেছিলেন চক্ষু ও হৃদরোগের। ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার ঢাকার নাজিরাবাজারের একটি ছোট বাড়িতে কয়েক বছর বসবাস করেছিলেন। ষাটের দশকে সিদ্ধেশ্বরীতে পুকুরের পাড়ে ফরিদপুরের পুলিশ ইন্সপেক্টর আখতারুজ্জামানের নিজস্ব টিনের বাড়ির এক অংশে সামান্য ভাড়ায় থাকত মুজিব পরিবার। নাজিরাবাজার ও সিদ্ধেশ্বরীতে বসবাসকালে তার এবং তার পরিবারের চিকিৎসা করতেন ডা. এম এন নন্দী, গোল্ড মেডালিস্ট। মুক্তিযুদ্ধকালে তার পরিবার থেকেছে ধানমন্ডিতে এ কে এম আহসান, সিএসপির ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডে একতলা বাড়িতে। তখন চিকিৎসা দিতেন পিজি হাসপাতালের প্রধান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক ওয়াদুদ ও সুফিয়া খাতুন। জাতির দুর্ভাগ্য, এই তিন বাসস্থানের কোথাও বঙ্গবন্ধুর একটি ছোট নামফলকও নেই।
এপ্রিল ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মাঝেমধ্যে বদহজম, পেটের নিম্নাংশে চিনচিনে ব্যথা ও পিত্তথলির সমস্যায় আক্রান্ত হন। পিজি হাসপাতালের (বর্তমান বিএসএমএমইউ) পরিচালক ডা. নুরুল ইসলাম ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ স্থির করেন, বঙ্গবন্ধুর পিত্তপ্রদাহ ও পিত্তে পাথর হয়েছে, অপারেশন প্রয়োজন। পিত্তপাথর ও প্রদাহের চিকিৎসা বাংলাদেশে না করে চিকিৎসার নিমিত্তে তাকে বিলেতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেন।
১৯৭২ সালের ৩০ জুলাই লন্ডনের হারলে স্ট্রিটে প্রাইভেট হাসপাতাল দ্য লন্ডন ক্লিনিকে শৈল্য বিশেষজ্ঞ স্যার এডওয়ার্ড মুইর, এফআরসিএস ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডা. নজরুল ইসলাম এফআরসিএস পেট কেটে বঙ্গবন্ধুর রোগ নির্ণয় করেন- 'পিত্তনালিতে কোনো পিত্তপাথর পাওয়া যায়নি। তারা বঙ্গবন্ধুর প্রদাহযুক্ত পিত্তথলি ও অ্যাপেনডিক্স অপসারণ করেন। লন্ডন ক্লিনিকে কয়েক দিন অবস্থানের পর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বঙ্গবন্ধু সুইজারল্যান্ডে যান এবং জেনেভা শহরে জেনেভা হ্রদের পাড়ে জেনেভা হোটেলে প্রায় দুই সপ্তাহ বিশ্রাম নেন। সেখানে তার সঙ্গে আমার একাধিকবার সাক্ষাৎ ও আলোচনা হয়েছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সুস্থ ছিলেন। কারাগারে সৃষ্ট রোগ এবং জেলের ডাক্তারদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক বন্দিদের একা রাখা তো শাস্তি দেওয়ার জন্য। কারাগারে একাকী থাকা যে কত কষ্টকর, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না। জেল কোডে আছে, কোনো কয়েদিকে তিন মাসের বেশি একাকী রাখা চলবে না। একাকী রাখার কারণে বঙ্গবন্ধু অনশন করেছিলেন। একাকিত্বের কারণে মানসিক অবসাদ, চিত্তভ্রংশ ও মায়ায় ভোগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক পাগল হয়ে গেলেন। তিনি নিজেকে সমস্ত দুনিয়ার খলিফা ঘোষণা করেন।
কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিপিবদ্ধ করেছেন, 'অনেক ডাক্তার দেখেছি, যারা কয়েদিদের কয়েদিই ভাবে, মানুষ ভাবে না, রোগ হলে ওষুধ দিতে চায় না। পকেটে করে ওষুধ বাইরে নিয়ে বিক্রি করে। ঘুষ খায় চিকিৎসা করার নামে। টাকা পেলে হাজতিদের যার অসুখ নেই, তাদের মাসের পর মাস হাসপাতালে সিট দিয়ে রেখে দিয়েছে আর যে সত্যি রোগী তার স্থান নেই। ম্যাজিস্ট্রেট যখন দেখতে যান কয়েদিদের অবস্থা, তখন হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি দেখায়। এতে জামিন পাওয়া সহজ হয়।'
ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র