যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুতির আহ্বান


৬ মার্চ, ১৯৭১। সংগ্রামী বাংলা এ দিনও সভা-সমাবেশ-মিছিলে উত্তাল ছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর ডাকা পাঁচ দিনব্যাপী হরতালের শেষ দিন এবং ঢাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো হরতাল পালিত হয়। মোট কথা, পূর্ণোদ্যমে পালিত হয় হরতাল, চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন। অলি আহাদের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে জনসভা এবং ন্যাপ নেতা মোজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ন্যাপের এ গণসমাবেশে মোজাফফর আহমদ জনগণকে মুক্তির জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এ ছাড়া ওই দিন সাংবাদিক ইউনিয়ন, শিক্ষক সমিতি, মহিলা পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ), কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল, শ্রমিক ইউনিয়ন, গণশিল্পী গোষ্ঠী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, স্বজনী ও ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল এবং বাংলা ন্যাশনাল লীগের উদ্যোগে জনসভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রাজধানীতে এক বিরাট শোভাযাত্রা এবং সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক বিরাট মশাল মিছিল বের হয়। টঙ্গীতে সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কাজী জাফরের সভাপতিত্বে এ দিন শ্রমিক সভা ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। মহিলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে বাংলার বিক্ষুব্ধ নারীরা বাঁশের লাঠি, লোহার রড ও কালো পতাকা নিয়ে উপস্থিত হন এবং সমাবেশ শেষে এক জঙ্গি মিছিল বের করেন তারা।
একই সঙ্গে বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল সাংবাদিক জনসমাবেশ। ‘আপসের বাণী আগুনে জ্বালিয়ে দাও’ শীর্ষক আহ্বান জানিয়ে লেখক-শিল্পীদের মুখপত্র ‘প্রতিরোধ’-এর দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তাদের স্লোগান ছিল পরিষদ বৈঠক বর্জন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
বেলা ১১টার দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। জেল থেকে পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। এ দিন প্রায় ৪ লাখ লোকের এক বিশাল গণবাহিনী যশোরে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ভীত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তারা ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যায়। এ সময় বহু পাকিস্তানি সৈন্য জনতার হাতে ধরা পড়ে ও অনেক বিহারি লুটতরাজের সময় জনরোষে নিহত হন।
এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে চলতে থাকে সভা-সমাবেশ-মিছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ দিনও কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। একই সঙ্গে বেলা আড়াইটা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ব্যাংক ও যে সব বেসরকারি অফিসের কর্মচারীরা বেতন পাননি সে সব অফিস শুধু বেতন প্রদানের জন্য খোলা থাকে।
‘যদ্দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি তদ্দিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব’ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এ দিন আওয়ামী লীগকে সতর্ক করে ভাষণদানকালে এ কথা বলেন। সেখানে তিনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় আহ্বান করেন। সেই সঙ্গে লে. জে. টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগের সরকারি ঘোষণা দেন। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ইয়াহিয়া খানের একটা ভাঁওতাবাজি। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সময় বৃদ্ধি করা। যার প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী দিনগুলোর ঘটনা প্রবাহে।
রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্টের এই ভাষণকে স্বাগত জানান। ইয়াহিয়া খানের এই বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। প্রেসিডেন্টের এই ভাষণের অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও বাংলাদেশ শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার এই বৈঠকে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
এদিন বিকেলে লাহোরে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বি এ সলিমী ও পাঞ্জাব প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদ সরফরাজসহ ১৬ জনকে একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারের দাবি জানান।
এ দিন সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় হাইকমান্ড এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওদিকে পল্টন ময়দানে জাতীয় লীগের জনসভায় আতাউর রহমান খান হত্যা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ করে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য সামরিক সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি জনগণকে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
এ দিন লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) নূর খান এক সমাবেশে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। তিনি আরো বলেন, অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা দূর করতে হবে।

SUMMARY

224-1.gif