আতিউর রহমান
মুজিববর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা আরও নতুন রূপে দেখতে পাব। তিনি কতটা সাধারণ মানুষ অন্তপ্রাণ ছিলেন, তা নিশ্চয় এ বছর আরও বৃহৎ কলেবরে প্রস্টম্ফুটিত হবে। আমি মনে করি, মুজিববর্ষে নতুন প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম, দেশ গড়ার চিন্তা, একটি জাতিকে সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধশালী করে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো আরও সুন্দরভাবে তুলে ধরার একটা মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর হৃদয়মাঝে সারাজীবন তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। আর তাই যখনই যেখানে গিয়েছেন, মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন সাধারণ মানুষের কথা, কৃষি ও কৃষকের কথা, শ্রমিকের কথা। তাঁর শোষণহীন সমাজ গঠনের স্বপ্নের জমিনের বড় অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশের কৃষক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ তারিখের ভাষণেও এ দেশের কৃষক সমাজের অধিকার সংরক্ষণের কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। তারও বহু আগে পাকিস্তানের গোড়ার দিনগুলোতে তিনি কৃষকের স্বার্থে ক্ষতিপূরণবিহীন জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবি করেছেন। 'দাওয়াল' বা মৌসুমি কৃষি শ্রমিকের সপক্ষে আন্দোলনে নেমেছেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানোর পর বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন, তাতে কৃষকদের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর দশ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না।' '৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি সরাসরি কৃষি বিপ্লবের কথা বলেন। উদাত্ত কণ্ঠে বলেন, গ্রাম ও কৃষির উন্নয়ন না হলে আমার এ দেশ এগোতে পারবে না। তাই কৃষি উন্নয়নের দিকে সবাইকে নজর দিতে হবে। তিনি বলতেন, কৃষকের চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষকের চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া হলে উৎপাদন বাড়বে, দেশ সমৃদ্ধ হবে। কৃষির স্বার্থেই গ্রামগঞ্জে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা বলেছেন। সেচ, সার ও বীজ সহজলভ্য করে কৃষির আধুনিকায়নের কথা বলেছেন। কৃষি খাতে গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। কৃষি স্নাতকদের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার সম্মান দিয়েছেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। পুষ্টিমান খাবার উৎপাদনের আহ্বান জানিয়েছেন।
সারা বাংলাদেশের হৃদয়কে এক করার নিরলস প্রচেষ্টায় তিনি কৃষকদের চাওয়া-পাওয়াকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। গরিবহিতৈষী বঙ্গবন্ধু সে জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কৃষকদের দিকে নজর দেন। তিনি সবসময় এও বলতেন, 'আমার দেশের কৃষকেরা সবচাইতে নির্যাতিত।' তাই তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নে তিনি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। উন্নত বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। পঞ্চাশের দশকে তাঁকে দেখেছি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কৃষকের পক্ষে কথা বলতে। ষাটের দশকে দেখেছি ছয় দফার আন্দোলনে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সোচ্চার হতে। আর স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দেখেছি সর্বক্ষণ কৃষক অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধুকে। মাটি ও মানুষের স্বার্থে বঙ্গবন্ধু কৃষকদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়নে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। এ জন্য নতুন নতুন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেন। বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, জরুরি ভিত্তিতে বিনামূল্যে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে অধিক কৃষিপণ্য উৎপাদনে ধানবীজ, পাটবীজ ও গমবীজ সরবরাহ করা হয়। দখলদার পাকিস্তানি শাসনকালে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেওয়া হয় ও তাদের সব বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে দেওয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করা হয়। ধান, পাট, তামাক, আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তির লক্ষ্যে নূ্যনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। গরিব কৃষকদের বাঁচানোর স্বার্থে সুবিধাজনক নিম্নমূল্যের রেশন সুবিধা তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসা হয়।
বঙ্গবন্ধু প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য নিবারণের তাগিদে কৃষি উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের পর্যায়ে আনা হয়। ওই সময় দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ। বিরাজমান খাসজমির সঙ্গে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণযোগ্য জমির সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য বঙ্গবন্ধু পরিবারপিছু জমির সিলিং ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রাথমিক হিসেবে ৩০ লাখ টন। তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে এবং স্বল্প মেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করে এবং কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করা হয়।
কৃষকের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন ফর্মুলা নির্ধারণে অত্যন্ত জোরদার উদ্যোগ নেন। এর ফলে ভাটির দেশ হিসেবে গঙ্গার পানির ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা পাওয়ার সম্মতি তিনি আদায় করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অসহায় কৃষকদের জন্য বাড়তি পানি প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য মানবিক কূটনীতির আওতায় জোরালো আহ্বান জানান। সে জন্যই এমন পানি চুক্তি চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৬৮-৬৯ সালের ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্পের স্থলে ১৯৭৪-৭৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার। এর ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ লাখ একরে উন্নীত হয়। বাংলার কৃষককে সারে ভর্তুকি দিয়ে তাদের বেশি বেশি ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করেন বঙ্গবন্ধু। গঙ্গা নদীর প্রবাহ থেকে অধিক পানিপ্রাপ্তি, সেচব্যবস্থার প্রসার, উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত খাস জমিপ্রাপ্তি এবং মূল্য সমর্থনমূলক সচেতন ও কৃষকদরদি নীতির ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল; তারই ফলে আজ কৃষিক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা বজায় রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই ধারাকে আরও বেগবান করেছেন। আজ কৃষির সবক'টি উপখাতেই উদ্বৃত্তের বাতাস বইছে।
কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, বিশেষ করে অধিক ফসল উৎপাদন, সেই সঙ্গে উৎপাদিত কৃষিপণ্য কৃষকরা যাতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারেন, সেদিকে বঙ্গবন্ধুর সুদৃষ্টি ছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে কৃষি উৎপাদনের প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ খুব বেশি না থাকলেও এগুলোর প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন। কৃষিকাজের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সেচ, সার, বীজ ইত্যাদি ব্যবহারে কৃষকদের তাদের নিজ বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে বলতেন। জেলা গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন কৃষি ও কৃষকদের প্রতি নজর দেওয়ার জন্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, কৃষিই যেহেতু এ দেশের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস, সেহেতু কৃষির উন্নতিই হবে দেশের উন্নতি। জমির মালিক ও কৃষি শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেই তিনি বাধ্যতামূলক সমবায় ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
'৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বেতার-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, 'আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়; আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ ও অবিচারমুক্ত নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলব। এই লক্ষ্য পূরণে ব্যাংকগুলোকে জাতীয়করণ করেন এবং গ্রাম-গঞ্জে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের শাখা সম্প্রসারণ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে স্বল্পসুদে গ্রামীণ মানুষের কাছে ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। একই সঙ্গে তিনি বীমা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন।'
বঙ্গবন্ধুর আমলেই শুরু হয় কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তিনি বেশ কয়েকটি কৃষি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন- এ রকম অনেক প্রতিষ্ঠানই তিনি গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধু অসম্ভব রকম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এক নেতা ছিলেন বলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন ছাড়া এ দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এদিকে ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় তিনি জোর দিয়েছিলেন সমবায়ভিত্তিক চাষবাসেও। সেখানে মূল লক্ষ্য ছিল জোতদার কৃষকের শোষণ থেকে ছোট বা ক্ষুদ্র কৃষকের স্বার্থ সংহত করা।
আজ কৃষিতে আমাদের যে অনন্য সাফল্য, তা বঙ্গবন্ধুরই চিন্তার ধারাবাহিকতা। তাঁর চিন্তাকে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা সুনিপুণভাবে বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়েছেন। এ কারণে আজ আমরা খাদ্যে যথেষ্ট স্বয়ংসম্পূূর্ণ। আজ কোথাও খাদ্যের কোনো ঘাটতি নেই। বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদনে আজ আমরা অনেক এগিয়ে। দিন যত যাচ্ছে ততই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশে কৃষির গুরুত্ব বাড়ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ প্রযুক্তিনির্ভর হলেও এ কথা আজ স্বতঃসিদ্ধভাবে সত্য- কৃষির আধুনিকায়ন ও যৌথ প্রয়াস ছাড়া এ সভ্যতা টিকবে না। শিল্প কৃষিকে প্রভাবিত করে। তার আগে এ কথা মানতে হবে যে, কৃষিই শিল্প খাতকে চালিত করে। আবহমানকাল ধরেই বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর অঞ্চল। বর্তমানে দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪১ শতাংশ প্রত্যক্ষভাবে কৃষি পেশায় নিয়োজিত। জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ১৫ শতাংশ। সব অর্থেই বাংলাদেশ এখন আধুনিক ও উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে। সামন্ত কৃষিব্যবস্থার পরিবর্তন করে আধুনিক কৃষি ও শিল্পনির্ভর দেশ হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষির আধুনিকায়ন হচ্ছে বলেই আজ আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর পেছনে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান অনস্বীকার্য।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ; বাংলাদেশ ব্যাংকের
সাবেক গভর্নর
dratiur@gmail.com