জুনাইদ আহ্মেদ পলক
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত। তখন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাই অগ্রাধিকারে থাকার কথা। এ ছাড়া তখনও গোটা বিশ্ব অ্যানালগ যুগে পড়ে আছে। কিন্তু তখনই, সেই সত্তরের দশকে, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। তখনই তিনি একটি বিজ্ঞানমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন দেশবরেণ্য বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিনকে। তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন, যাতে করে বাংলাদেশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের সদস্য হতে পারে। বেতবুনিয়ায় স্থাপন করেছিলেন ভূউপগ্রহ কেন্দ্র। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সেই পথ ধরেই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশনের পথে চলছে। চলছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে।
বাংলাদেশ অনেক আগেই ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের ওপরে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশের এই দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ম্যাজিক বা রহস্য কী? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের নীতি-কৌশল। এ নীতি শুধু দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে নয়, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করায় বড় অবদান রাখছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের নীতি-কৌশল প্রয়োগের কারণে ২০১১ সালে প্রবল বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার (২০০৮ সাল থেকে যার শুরু) মধ্যেও দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধারা অব্যাহত থাকে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আর্থিক প্রযুক্তির বর্ধিত ও বহুমাত্রিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে শক্ত অবস্থান তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির কারণে অর্থব্যবস্থায় পদ্ধতিগত পরিবর্তন ঘটছে, যা মূলত টেকসই উন্নয়নের অনুঘটক।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের চারটি স্তম্ভ রয়েছে। এর দ্বিতীয় স্তম্ভে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়। এতে বলা হয়, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং অর্থপূর্ণভাবে নাগরিকদের সংযুক্ত করার কথা। অর্থাৎ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা সহজলভ্য করে কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। ব্যাপকভিত্তিক ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমেই এটা সম্ভব। এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয় নীতিমালা ও অবকাঠামো তৈরির। সে জন্য ২০০৯ সাল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে প্রথমে নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি আইসিটি অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর বাস্তবায়ন শুরু হয় গ্রাম থেকে। প্রধানমন্ত্রী তার গভীর উপলব্ধি থেকেই 'বটমআপ অ্যাপ্রোচ' পদ্ধতি অনুসরণ করে তৃণমূল থেকে ডিজিটালাইজেশনের কার্যক্রম শুরু করেন। এ ধরনের চ্যালেঞ্জিং এবং সাহসী উদ্যোগ গ্রহণের মূলে কাজ করেছে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ করে দিয়ে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো। যে কোনো সমাজ বা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করে তথ্য ও সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ করে দেওয়া হলে তা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হিসেবেই বিবেচিত হয়। আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের বাস গ্রামে। শহরের পাশাপাশি গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসার জন্য সাড়ে চার হাজারেরও বেশি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) স্থাপন করা হয়। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ওয়ার্ড মিলে বর্তমানে ডিজিটাল সেন্টারের সংখ্যা ৫৮৬৫টি। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি পৌঁছে দেওয়া হয় ইউনিয়নগুলোতে। ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসার জন্য সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা, দ্বীপ এমনকি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মহেশখালী দ্বীপের মানুষ ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি সেবা পাচ্ছে। হাওর এলাকার মানুষকে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির আওতায় নিয়ে আসার জন্য প্রকল্পের বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দুর্গম এলাকার ৭৭২টি ইউনিয়নে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে 'কানেক্টিং বাংলাদেশ' প্রকল্পের। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প ঘোষণার আগে গ্রামে বসে ডিজিটাল সেবা পাওয়ার কথা কেউ কল্পনাও করেনি। অথচ আজ শুধু ডিজিটাল সেন্টার থেকেই ১৫০ ধরনের সরকারি ও বেসরকারি সেবা প্রদান করা হচ্ছে। বিগত এক দশকে ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে প্রায় ৪৫ লাখ কোটি সেবা প্রদান করা হয়েছে। দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ এখন মোবাইল নেটওয়ার্ক কভারেজের আওতায়। মোবাইল ফোন গ্রাহকসংখ্যা ১৬ কোটি ৪১ লাখ ৭০ হাজারে উন্নীত হয় (অক্টোবর ২০১৯ পর্যন্ত)। একই সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৬৫ হাজার।
আমানত ও ঋণের মতো মৌলিক আর্থিক সেবাপ্রাপ্তি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির অন্যতম নির্ণায়ক। আর্থিক ব্যবস্থায় সব শ্রেণির মানুষের অন্তর্ভুক্তির টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক সেবার বাইরে থাকা প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে আর্থিক সেবাভুক্তি কার্যক্রমের আওতায় আনার জন্য ২০১১ সালে উদ্যাগ গ্রহণ করা হয়। এ উদ্যোগের দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে গেছে গ্রাম, দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায়। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করছে। মোবাইল ব্যাংকিং এখন অলটারনেটিভ পেমেন্ট চ্যানেল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা লেনদেন দেয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা ৭ কোটি ৫৫ লাখ।
বাংলাদেশের মূলধারার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে সহজ ও টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আর্থিক সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকসংখ্যা ৫২ লাখ এবং গ্রাহকরা ৭ কোটি টাকা জমা রাখেন। দেশের ৩৮০০ ডিজিটাল সেন্টারে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু আছে। বিভিন্ন ব্যাংক সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে (ইএফটি) ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। আর্থিক সেবাভুক্তি কার্যক্রমে মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং যুগান্তকারী ঘটনা এবং এর সুফলভোগীদের বেশিরভাগের বাস গ্রামে।
ই-গভর্মেন্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণ এবং সরকারের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি তথ্য ও সেবা ইন্টারঅপারেবল (আন্তঃপরিবাহী) করার জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচার (বিএনডিএ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্মার্টকার্ড, ইউনিক আইডির বায়োমেট্রিক ডাটা বেইজ সেবা প্রদানকে সহজ করেছে। সরকার ইতোমধ্যে ১০ কোটি ডিজিটাল আইডি প্রদান করেছে। মানুষের দোরগোড়ায় তথ্য ও সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য জাতীয় তথ্য-বাতায়ন তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে এ তথ্য-বাতায়নে ৪৫ হাজার ওয়েবসাইট ও সরকারি বিভিন্ন সেবা রয়েছে। ৬শ'রও বেশি সরকারি সেবা ডিজিটাইজড করে তাতে নাগরিকদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগের বাস্তবায়নের ফলে জাতিসংঘের ই-গভর্মেন্ট সূচকে বাংলাদেশের বড় উত্তরণ ঘটে ২০১৮ সালে। জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশের ই-গভর্মেন্ট কার্যক্রম নিয়ে দুই বছরের অগ্রগতি পর্যালোচনা শেষে ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ডেভেলপমেন্ট সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে ৯ ধাপ আর ই-পার্টিসিপেশন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের ৩৩ ধাপ উন্নতি হয়।
ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম আরও ব্যাপকভিত্তিক করার পরিকল্পনার কথা মানুষ জানতে পারে ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে। এ বছরের ১৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণায় 'আমার গ্রাম- আমার শহর :প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ' অংশে গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। এতে বলা হয়, শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হবে। আগামী পাঁচ বছরে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। পাকা সড়কের মাধ্যমে সব গ্রামকে জেলা-উপজেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা হবে। কর্মসংস্থানের জন্য জেলা-উপজেলায় কলকারখানা গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি সর্বত্র পৌঁছে যাবে। সুপরিকল্পিতভাবে 'আমার গ্রাম- আমার শহর' কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে সব মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে নাগরিক অধিকার ও নাগরিক আধুনিক সব সুবিধা, বিশেষ করে তথ্য ও সেবা পৌঁছে দেওয়ায় অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি।
রূপকল্প-২০২১-এর অবিচ্ছেদ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর বাস্তবায়ন দেশের মানুষের সামনে সম্ভাবনার তোরণ দুয়ার খুলে দিয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ২০১৫ সালেই বিশ্বব্যাংকের নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে একটি জ্ঞানভিত্তিক আধুনিক বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, পরামর্শ ও তদারকিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সাফল্য ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন এবং রূপকল্প-২০৪১-এ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথকে মসৃণ করবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ব্যাপকভিত্তিক ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এর পাশাপাশি উন্নয়নকে করবে টেকসই।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী