অমিত বিশ্বাস :
৪ মার্চ, ১৯৭১। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ও গণহত্যার প্রতিবাদে বাংলার মুক্তিকামী মানুষের অসহযোগ আন্দোলনের চতুর্থ দিনটি ‘পূর্ণ হরতাল, বিক্ষুব্ধ শোভাযাত্রা, গায়েবানা জানাজা, সভা ও স্বাধীনতার শপথ’ নেয়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকাসহ সারা বাংলায় জনগণের অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফ‚র্ত হরতাল পালিত হয়। ফরিদপুর সিটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের করা হয়। এ দিন ঢাকার কারফিউ তুলে নেয়া হলেও খুলনা ও রংপুরে কারফিউ বলবৎ থাকে। খুলনায় পাকবাহিনীর গুলিতে বহু হতাহত হয়। যশোরে পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন মিছিলে অংশ নেয়া চারুবালা ধর।
৩ ও ৪ মার্চ এই দুদিনে চট্টগ্রামে ১২০ জন বাঙালি নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হন। ঢাকায়ও এ দুদিনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১। ঢাকাসহ সারা দেশে গায়েবানা জানাজা ও শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হয় শহীদদের স্মরণে। বাড়তে থাকে আন্দোলনের গতি। মোটকথা, সারা বাংলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে স্বাধিকার আন্দোলনে যোগ দেন। ন্যাপপ্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাঙালির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবি জানান। তিনি বলেন, কংগ্রেস, খেলাফত, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মাধ্যমে আমি আন্দোলন করেছি কিন্তু ৮৯ বছরের জীবনে এবারের মতো গণজাগরণ ও অগণতান্ত্রিক ঘোষণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিক্ষোভ কখনো দেখিনি।
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা হরতাল চলাকালে শান্তিরক্ষার জন্য শহরের রাজপথে টহল দিতে থাকেন। হরতালের কারণে ঢাকার সঙ্গে বাইরের জল, স্থল ও বিমানপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের টেলিফোনকর্মীরা পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রাঙ্কল বুক ও টেলিগ্রাম পাঠানো থেকে বিরত থাকেন। এই দিন হরতাল চলাকালে সেনাবাহিনীকে তেমন টহল দিতে দেখা যায়নি। তবে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ও পিলখানা ইপিআর ব্যারাকের বাঙালি জওয়ানরা রাজপথের মিছিলকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মাধ্যমে। এই দিনে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবি জানায়। তারা সিদ্ধান্ত নেন, সরকার বা মালিকপক্ষ কোনো বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশনে যদি বাধার সৃষ্টি করে তাহলে তারা (সাংবাদিকরা) তা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করবেন। অন্যদিকে বেতার ও টেলিভিশনের ২০ জন শিল্পী এক যুক্ত বিবৃতির মাধ্যমে সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন, যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন, ততদিন পর্যন্ত তারা বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন না।
‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এই দিন থেকে প্রতিদিন আরো দুবার বাংলায় ‘স্থানীয় সংবাদ’ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ৫৫ জন শিক্ষক এক যৌথ বিবৃতিতে সাবেক পাকিস্তান অবজারভারের গণবিরোধী ভ‚মিকার তীব্র সমালোচনা করেন।
যে কোনো মূল্যে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশ জারি করা হয়। ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানান শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আরো বলেন, যেসব সরকারি কর্মচারী এখনো বেতন পাননি শুধু বেতন প্রদানের জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো আড়াইটা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শুধু বাংলাদেশের মধ্যে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চেক ভাঙানো যাবে। স্টেটস ব্যাংক বা অন্য কোনো মাধ্যমে বাংলার বাইরে টাকা পাঠানো যাবে না। হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার ও সাংবাদিকের গাড়ি, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সাপ্লাই, স্থানীয় টেলিফোন ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার টেলিফোন যোগাযোগ, দমকল ও আবর্জনার গাড়ি হরতালের আওতামুক্ত থাকবে বলে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, বিশ্বাবাসী দেখুক, বাংলাদেশের নিরস্ত্র ছাত্র-শ্রমিক জনতা বুলেটের মুখেও কী দুর্দান্ত সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।
গভর্নরের বেসামরিক দায়িত্বে নিয়োজিত মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বঙ্গবন্ধুর কাছে কতিপয় প্রস্তাব নিয়ে যান এই দিন রাত ১১টায় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে তার লোকেরা কীভাবে মারা যাচ্ছে তার বর্ণনা দেন ও বঙ্গবন্ধুর দাবি মেনে নেয়ার দাবি জানান। আলোচনার একপর্যায়ে তাজউদ্দীন আহম্মদ সেখানে উপস্থিত হন এবং উপস্থিত হয়েই তিনি দৃঢ় কণ্ঠে রাও ফরমান আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এখন আর এক ছাদের নিচে আমাদের অবস্থান সম্ভব নয়। এরপর আলোচনা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি এবং ওই রাতেই প্রেসিডেন্ট রাও ফরমান আলী খানকে ইসলামাবাদে সাক্ষাতের নির্দেশ দেন। এই দিন অব্যাহতিপ্রাপ্ত গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস এম আহসান রাতে বিমানে করে করাচি রওনা হন। যাওয়ার আগে তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানান।
অন্যদিকে করাচি প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। পিডিপি প্রধান নূরুল আমীন এই দিন ঢাকায় এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ ঢাকায় রাজনৈতিক নেতাদের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্টকে অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার আহ্বান জানান। লে. জে. টিক্কা খানকে পূর্বাঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ করা সম্পর্কিত টেলিফোন সংবাদ জানার পর লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খান পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।