সিমিন হোসেন রিমি
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সকালবেলা আমার ঘুম ভেঙেছিল প্রচণ্ড গুলির শব্দে। ঘর থেকে বের হয়ে দেখি– বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, মা জোহরা তাজউদ্দীনসহ পরিবারের সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের সাত মসজিদ রোডের সেই বাসা। আমরা বুঝতে পারছিলাম না, কী ঘটছে। বাবাকে খুব অস্থির দেখাচ্ছিল। তিনি নানান জায়গায় ফোন দিচ্ছিলেন, কিন্তু কেউ ফোন তুলছিল না। সকালের আলো ফুটতে রাস্তায় দু-একজন মানুষ বের হতে থাকে। তারাও যেন বিভ্রান্ত। একজন রাস্তা থেকেই বললেন রেডিও অন করতে। রেডিও খোলার সঙ্গে সঙ্গে মেজর ডালিমের সেই নারকীয় কণ্ঠ। বাবা একবার শুনে বিষণ্ণ হয়ে গেলেন।
তাজউদ্দীন আহমদকে আমরা কখনও বিষণ্ণ দেখিনি। সবসময় তার মুখে একটি স্মিত হাসি থাকত। অনেক কঠিন সময়ে কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ও সেই হাসি মিলিয়ে যেত না। বাবা এমনিতেই অযাচিত কথা বলতেন না। সবাই যে কারণে তাকে খুব সমীহ করত। রেডিওতে ডালিমের ঘোষণা শোনার পর যেন আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন না। একবার মাকে ডেকে বলতে থাকলেন– তুমি কিছু দিন আগে জানতে চেয়েছিলে যে, রাতে একা একা আমি কোথায় গিয়েছিলাম। ৩২ নম্বরে মুজিব ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম, চারদিকে নানা ষড়যন্ত্র চলছে, সতর্ক থাকুন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন– তাজউদ্দীন, তুমি ভয় পেয়ো না। আমাকে কেউ কিছু করতে পারবে না। বাবা যেন হঠাৎ অনেক কথা বলছিলেন। নিজে নিজেই, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো– আমি ক্যাবিনেটে থাকলে কেউ মুজিব ভাইকে স্পর্শ করতে পারত না। তিনি জানতে পারলেন না কে তার শত্রু, কে তার বন্ধু।
আম্মা বাবাকে বললেন, তুমি বাসা থেকে অন্য কোথাও চলে যাও। বাবা বললেন, তিনি যাবেন না। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে আমাদের বাসা ঘিরে ফেলল। একজন অফিসারের মতো কেউ এসে বলল, আপনারা কেউ বাসা থেকে বেরোতে পারবেন না। বাসার ছাদে ছাদে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট সেট করা হলো। এভাবে এক সপ্তাহ অবরুদ্ধ অবস্থায় কাটল।
একদিন একদল পুলিশ এসে বাবাকে বলল তাদের সঙ্গে যেতে হবে। আমরা চার ভাইবোন। আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। বড় বোন টেনে। অন্য দু'জন আরও ছোট। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, আমরা চার ভাইবোন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাবা পুলিশের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছেন। আম্মা পেছনে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন– কবে ছাড়বে? কতদিনের জন্য নিয়ে যাচ্ছে? বাবা ইংরেজিতে বললেন– 'টেক ইট ফরেভার। ধরে নাও চিরদিনের জন্য যাচ্ছি।'
আমরা গাড়িবারান্দা পর্যন্ত পেছনে পেছনে গেলাম। আমাদের বাসার সামনে রাস্তার ওপাশে একটি মুদি দোকান ছিল। পাশে বড় একটি গাব ও তেঁতুল গাছ। লক্ষ্য করলাম, সেখানে একজন শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। বাবাকে যখন পুলিশের জিপের সামনের আসনে ওঠানো হচ্ছিল, তখন তিনি দৌড়ে গাড়ির কাছে এলেন। ইংরেজিতে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলেন। বাবাও কী যেন উত্তর দিলেন। পুলিশ খুব দ্রুততার সঙ্গে তাকে সরিয়ে দিল এবং গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।
ওই ঘটনার দুই দশক পর আমি জেনেছিলাম ভদ্রলোকের নাম লরেন্স লিফসুজ, মার্কিন সাংবাদিক। তিনি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন– আপনার কি মনে হয় মন্ত্রিসভায় শপথ নেওয়ার জন্য আপনাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাবা উত্তরে বলেছিলেন– না, আমার তেমন মনে হয় না। পরবর্তী এক মাস আমরা গৃহবন্দি ছিলাম। কোথাও কোনো যোগাযোগ করতে দিত না। এরপর জেলখানায় বাবার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাই।
জেলখানায় বাবার সঙ্গে শেষবার আমাদের ভাইবোনদের দেখা হয় ২২ বা ২৩ অক্টোবর। দেখা করার জন্য যে ওয়েটিং রুম, সেখানে আমরা বসে ছিলাম। সঙ্গে ছিল গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন। জেলখানার ভেতর থেকে আব্বার হেঁটে আসা দেখা যায়। তিনি ঢুকেই আম্মাকে বললেন– আমাদের বোধহয় আর বাঁচিয়ে রাখবে না। আমি মুজিব ভাইকে স্বপ্নে দেখেছি। তিনি বলছেন– তাজউদ্দীন, তোমাকে ছাড়া আর ভালো লাগে না। তুমি চলে আসো। এটা বলার সময় আব্বার মুখে একটা প্রশান্তির হাসি। সেটাই আব্বার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
বাবার মুখে এই কথা শুনে মা খুব উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে একটি রিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেসব কাগজপত্রে স্বাক্ষরের জন্য আম্মা আইনজীবীদের নিয়ে নভেম্বরের ১ তারিখ জেলখানায় গিয়েছিলেন। দিনটি ছিল শনিবার, আমরা যেতে পারিনি। ওইদিন এসে আম্মা আরও উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। বললেন, ওয়েটিং রুমে সাদা পোশাকে অনেক লোক ছিল। তারা বেশি কথা বলতে দেয়নি। অন্যান্য দিন এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হলেও ওইদিন মাত্র ২০ মিনিট সময় দিয়েছিল। ওই রিটের শুনানি হওয়ার কথা ছিল নভেম্বরের ৫ তারিখ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেদিনই তাজউদ্দীন আহমদকে কবর দেওয়া হয়।
লেখক: তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা; সংসদ সদস্য