সাইদ আহমেদ বাবু
মনে পড়ে কৈশোরের স্মৃতি। ঊনসত্তরের ২২ ফেব্রুয়ারির কথা। ওই দিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান। তখনও 'বঙ্গবন্ধু' নামে পরিচিত হননি, শেখ মুজিব নামেই তখন দেশব্যাপী পরিচিত ছিলেন। সেদিন সকালে আমরা মিছিলে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় ধানমন্ডির ২৭ নম্বরের বাড়ির সামনে পার্কে বসে আছি। আগের দিন ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ ভাষা দিবস, তার ওপর দেশে আন্দোলন, ধানমন্ডি ৩২নং রোড একেবারে ফাঁকা, কাকপক্ষীও নেই। জনশূন্য রাস্তা, আনুমানিক সকাল ১০টা বা সাড়ে ১০টা হবে। তখনই দেখতে পেলাম আর্মির পাঁচটি গাড়ি খুব জোরে ৩২ নম্বর বাড়িটির সামনে এসে থেমে গেল। তাদের দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যাই। আগে কখনও কাছ থেকে এত মিলিটারি দেখিনি। তারা একজন দীর্ঘদেহী সুদর্শন পুরুষকে মাঝের একটি গাড়ি থেকে নামিয়ে বাড়ির গেটে পৌঁছে দিয়ে ঝড়ের বেগে মিরপুর রোড দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটে চলে গেল।
খবরের কাগজে ছবি দেখেছি, তাই শেখ মুজিবকে চিনতে ভুল হলো না। তাকে জেল থেকে মুক্ত করার জন্য আমরা মিছিলে স্লোগান দিই! কৌতূহলবশত বিনা বাধায় বাসার ভেতর ঢুকে গেলাম। সামনে গিয়ে স্লোগান দিলাম- 'আমার নেতা, তোমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব'। তিনি হাত দিয়ে ইশারা করে আমাদের থামিয়ে দিলেন। আমাদের বয়স দেখে হয়তো অবাক হয়েছেন। দারোয়ানের কাছে জানতে চাইলেন, বাচ্চারা কারা? দারোয়ান বললেন, কামাল ভাইয়ের সঙ্গে মিছিলে যাওয়ার জন্য এসেছে। আমি সালাম দিলাম। তিনি হেসে সালামের জবাব দিলেন এবং কাছে ডেকে আমাদের সবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আন্দোলনের ওই দিনগুলোতে আমি সবে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছি। লেক সার্কাস কলাবাগানে আমাদের বাসা। এখানেই আমার শৈশব-কৈশোর কাটে, বাসা থেকে ৩২নং মিরপুর রোড রাসেল স্কয়ার দেখা যায়। বর্তমানে নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ, তখন সেখানে ছিল ও. কে স্পোর্টসের কারখানা, পান্থপথ রাসেল স্কয়ার ছিল ধানমন্ডি লেকের অতিরিক্ত পানি বের
হওয়ার খাল।
সেদিন থমথমে অবস্থা রাস্তায় খুব একটা গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। আর্মির গাড়ি বঙ্গবন্ধু বাসা থেকে ফিরে যেতে দেখে মিছিল করার জন্য সেদিন শুক্রাবাদে যারা অপেক্ষায় ছিল, তাদের মধ্যে কিছু মানুষ কৌতূহলবশত দৌড়ে বাসার দিকে আসতে থাকলেন। আনুমানিক ১০ মিনিট পর বাড়ির দ্বিতীয় তলার বারান্দায় বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা শাড়ি পরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছিলেন। শেখ মুজিব দোতলায় গিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করে আবার নিচে এলেন। আমরা যারা গেটের ভেতর ঢুকেছিলাম তারা বের হয়ে গেলাম। এর মধ্যে ঢাকা শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খবর হয়ে গেল, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তির পর বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাড়ির সামনে হাজার হাজার মানুষ। ঘণ্টাখানেক পর শেখ কামালের নেতৃত্বে ঢাকা কলেজ থেকে হাজার হাজার ছাত্রের বিশাল মিছিল এসে পুরো রাস্তা ভরে গেল। ছাত্রদের ভিড়ে অনেকে পার্কের ভেতর গাছে, দেয়ালে ওঠে শেখ মুজিবকে একপলক দেখার জন্য।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সদ্য মুক্ত বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, বাংলার ইতিহাসে তা আর দ্বিতীয়টি নেই। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ তাকে সেই সভায় 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেন। ডাকসুর ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ এই প্রস্তাব করলে লাখ লাখ জনতা হাততালি দিয়ে এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। সে সংবর্ধনায় আমারও উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম দেখার সেই স্মৃতির সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা হয় না।
সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক উপকমিটি