ড. মুহম্মদ মনিরুল হক
‘দাবা’ একটি খেলার নাম। তবে ক্রিয়া অর্থে চাপ দেওয়া, দমন করা, নিজের সম্পূর্ণ অধিকারে বা আয়ত্তে আনা বোঝাতে দাবা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ইতিহাসে বড় বড় কবি-সাহিত্যিকের প্রভাবে বিভিন্ন শব্দের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা বাড়ে। বাঙালির রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একান্তই আপন, নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দীর জনসভায় বলেছিলেন, ‘...সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না...।’ সেই থেকে ‘দাবায়ে’ এবং ‘দাবাতে’ (দাবিয়ে বা দাবাইয়া নয়) শব্দ দুটির ঐতিহাসিক ভিত্তি ও প্রবহমান ধারা বাঙালি জাতির চিন্তা, চেতনা, বৈশিষ্ট্যও রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন পুরোপুরি বাঙালি। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, বঞ্চনা-গঞ্জনা প্রতিনিয়তই তাঁকে ভাবিত করত। বঙ্গবন্ধুর আচার-আচরণ, ভাবভঙ্গি, চিন্তা-চেতনায় ফুটে উঠত বাঙালির সুখ-শান্তি ও মুক্তির দর্শন। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের মনের ভাব-ভাষা ছিল তাঁর নখদর্পণে। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথা, প্রতিটি উচ্চারণে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল মেহনতি শ্রমিক, কৃষক ও দেশপ্রেমী সুধীসমাজের মনের ভাব। শত শত বছর ধরে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনছে বাঙালি; সংগ্রাম করছে, রক্ত দিয়েছে এবং তার ফলে স্বাধীনতার যে প্রত্যাশাটি উন্মুখ হয়ে উঠেছে, তাকে ভাষা দিয়েছেন রাজনীতির মহান কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ভয়-ত্রাস এবং আশা ও সম্ভাবনায় উদ্বেল সাত কোটি মানুষকে এক কঠিন সংকটময় মুহূর্তে এই জাদুকরী ভাষণে রাজনৈতিক চেতনার একটি উত্তুঙ্গ স্তরে এনেছেন এবং স্বাধীনতার জন্য মরণপণ অঙ্গীকারদীপ্ত মুক্তিসেনানিতে রূপান্তরিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৭ই মার্চ ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক-অনন্য ভাষণটি ছিল অধিকারবঞ্চিত বাঙালির শত-সহস্র বছরের সংগুপ্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার উচ্চারণ। ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি উচ্চারণ মানুষের মনে আগুন জ্বালিয়েছিল, প্রত্যয় জাগিয়েছিল প্রতিশোধের। সেদিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর কখনো উঁচুগ্রামে নিনাদিত হয়েছে, কখনো ক্ষোভে-দুঃখে ভেঙে পড়েছে, কখনো বাংলার দুঃখী মানুষের বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে অবরুদ্ধ হয়েছে কণ্ঠ। আবার বজ্রদীপ্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে শ্রোতাদের নির্ভার ও নির্ভয়ও করেছেন। ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে কখনো কখনো নিজস্ব ও খাঁটি বাংলা শব্দের ব্যবহার (দাবায়ে রাখতে পারবা না) বক্তব্যকে করেছে দেশজ এবং মুজিব ব্যক্তিত্বের সপ্রাণ ওজস্বিতা।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ লিখিত কোনো বক্তৃতা নয়। তা স্বতঃস্ফূর্ত ও সরাসরি চেতনায় প্রস্ফুটিত হয়ে হৃদয় থেকে উৎসারিত। অতিকথনহীন, পুনরুক্তিহীন, হোঁচট খাওয়া বা বিরামহীন এ ভাষণ বাঙালির স্বপ্নের শব্দের নিখুঁত বুননে সমৃদ্ধ। তার সুর, তাল, ছন্দ, লয়ও যেন নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। মাত্র ১৮ মিনিট, মতান্তরে ১৯ মিনিটে এক হাজার ১০৫ শব্দের উচ্চারণ, অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া কথামালার গঠন কৌশল, কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, ইতিহাসের শিক্ষা, সময়জ্ঞান, শব্দচয়নের মুনশিয়ানা ও বঙ্গবন্ধুর সাবলীল ভঙ্গি, অমোঘ তীক্ষতা, অতুলনীয় বক্তৃতাশৈলী ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। ইউনেসকো কর্তৃক স্বীকৃতিও লাভ করেছে মানবজাতির দালিলিক ঐতিহ্যের অন্যতম ডকুমেন্ট হিসেবে। পূর্ববাংলার কোনো আঞ্চলিক ভাষা বা উচ্চারণে নয়, আবার পরিশুদ্ধ প্রমিত বাংলায় নয়, বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মানুষ ও সুধীসমাজের কাছে বোধ্যগম্য-আকর্ষণীয় ছিল প্রতিটি শব্দ-বাক্য-প্রত্যয়। সে কারণে বলা যায়, এটি বাংলা ও বাঙালির বঞ্চনা, হতাশা এবং সেখান থেকে জন্ম নেওয়া ক্রোধ ও সর্বোপরি আত্মপ্রত্যয় ও মুক্তিসংগ্রামের মহাকাব্য, ছোটগল্প এবং ভবিষ্যৎ চিন্তার উপন্যাস। ভাষার শক্তিতে, আবেগের স্ফুরণে এবং বক্তব্যের শাণিত ক্ষুরধারে অসাধারণ এবং অদ্বিতীয় ৭ই মার্চের এই ভাষণ বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ও পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তৃতা।
৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব বিশ্ব প্রেক্ষাপটেও অসাধারণ বহুমাত্রিক ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ। সেই প্রতীক্ষিত মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু এলেন, মঞ্চে উঠলেন, ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন—‘ভাইয়েরা আমার’ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো তাঁর কণ্ঠ। কণ্ঠে কখনো বেদনার কান্না, কখনো ক্রোধ, কখনো সমাহিত শান্ত অথচ দৃঢ়তা। আবেগ, রোমাঞ্চ, শিহরণ জাগানো বাক্যের উদ্দীপন, ক্রন্দনেও ইতিহাস মুখর হয়ে উঠেছে তাঁর বলায়। বঙ্গবন্ধু শুরু করেছেন সারা দেশে মানুষের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে এবং বাঙালির সহজাত বৈশিষ্ট্যের কথা দিয়ে। বলেছেন, পাকিস্তানি শাসকদের কাছে পাওয়া বঞ্চনা-নির্যাতন ও প্রতারণার প্রসঙ্গ। নিজের মানুষকে, নিজেদের মানুষকে জানিয়েছেন শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম, ইয়াহিয়ার আক্রমণাত্মক ভূমিকা ও ষড়যন্ত্রের কথা। স্বৈরাচার ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আত্মবিশ্বাস ও সৎসাহসের কথাও জানিয়েছেন। দ্বিধাহীন ও স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়কণ্ঠে সরকারের কাছে জানিয়েছেন প্রদত্ত দাবি ও শর্ত। দিয়েছেন বাঙালি জনগণের জন্য দিকনির্দেশনা। অতঃপর জনগণকে চরম সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি জানিয়ে নিজে নিয়েছেন বিকল্প সরকারের ভূমিকা।
স্বভাবতই সময়ের পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে ৭ই মার্চের ভাষণ হয়েছে কালোত্তীর্ণ ও যুগ-যুগান্তরের প্রেরণাদায়ী। সারগর্ভ, ওজস্বী ও যুক্তিযুক্ত, তির্যক, তীক্ষ স্বাধীনতার এ ভাষণ বাঙালির প্রজন্ম পরম্পরায়, সংশয়-সংকটে জাগিয়েছে প্রেরণাশক্তি ও উজ্জ্বল আলোর দিশা। ভাষণের প্রতিটি লাইনের মতোই অন্যতম ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষেরে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ দাবায়ে না থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘ সুঠাম ব্যক্তিত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধু সর্বদা মাথা উঁচু করেই চলেছেন, কেউ কখনো তাঁকে দাবায়ে রাখতে পারেনি। বাঙালি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও ইতিহাসের অনন্য বৈশিষ্ট্যও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। দমন-পীড়নের শৃঙ্খল ভাঙতে যুগ-যুগান্তরে রক্ত দিতেও পিছপা হয়নি বাঙালি। আজও হয় না। এটিই বাঙালির অহংকার, সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি—অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার মহানায়কও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধুকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : জেন্ডার, স্থানীয় সরকার ও উন্নয়ন গবেষক
dr.mmh.ju@gmail.com