৭ মার্চের ভাষণ : একটি বিশ্লেষণ


৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রমনায় রেসকোর্স ময়দানে, বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৮ মিনিট স্থায়ী ঐতিহাসিক ভাষণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় ভাস্বর। এ যাবৎ ১২টি ভাষায় অনূদিত এবং বিশ্বমানুষের কাছে সমাদৃত এ ভাষণে আনুষ্ঠানিক পূর্বচিন্তার প্রভাব থাকলেও এটিকে ‘এক্সটেম্পর’ বা তাৎক্ষণিক বক্তৃতা বলা যায়। গাঙ্গেয় পলিকাদার জমিন থেকে উঠে আসা এক সাহসী-অথচ-মমতাময় প্রাকৃতিক সন্তানের অকৃত্রিম ভাষাভঙ্গিই এ ভাষণের প্রাণ; ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারব না’- কথাটি উচ্চারণমাত্র একজন দরদি মানুষের ছবি ভেসে ওঠে, যিনি জনমানুষের সহমর্মী এবং যিনি হাসতে হাসতে জনতাকে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে পারেন। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে ভাষণটি উচ্চারণের পর এর একটি লিখিত ভাষ্যও প্রস্তুত হয় যাতে তাজউদ্দীন আহমদের কিছু পরিমার্জন স্বীকার করা হয়; সামরিক আইন প্রত্যাহারসহ নির্বাচিত আওয়ামী প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা সোপর্দ করার বিষয়টিতে গুরুত্বারোপের জন্যই তা করা হয়। ভাষণের সেই লিখিত ভাষ্য জনতার কাছে বিতরণ করা হয় সত্য, তবে ৭ মার্চের এ কালান্তরী ভাষণ স্বতঃস্ফূর্ত মৌখিক বয়ানে বিন্যস্ত। নিজ গরজে ছুটে আসা ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে প্রদত্ত এ ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দশটি ভাষণের মধ্যে অন্যতম হিসেবে যে নির্বাচিত, সে কথাও মনে রাখা দরকার।
ভাষণের প্রতিপাদ্য কোন পটভূমিতে স্থির হয় সেদিকটা একটু দেখা যাক। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে পাকিস্তান সামরিক শাসকচক্র। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বাঙালি শোষণের মাধ্যমে আখের গোছানোই ছিল তাদের লক্ষ্য। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনালের ইয়াহিয়া ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলেও ১ মার্চ তা আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হয়। এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে একযোগে হরতাল ডাকেন; সর্বাত্মকভাবে তা পালিত হয়। ৩ মার্চ পল্টনের জনসমুদ্র থেকে তিনি সমগ্র পূর্ব বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন। ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় যে বিপুল লোকসমাগম হয় তা ছিল এক বিস্ময়কর মানবজাগরণ। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব অংশের স্বাধীনতার জন্য ভাষণটি দেয়া হলেও সার্বিকভাবে সমগ্র রাষ্ট্রের উদ্দেশেই তা উচ্চারিত। ভাষণের প্রথম বাক্যেই বোঝা যায় কোন্ পটভূমিতে তিনি ওই ময়দানে দাঁড়িয়েছিলেন- ‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি।’ কেন তার মন দুঃখভারাক্রান্ত তারও জবাব মেলে পরে, যখন তিনি বলেন, ‘কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’
কোনোক্রমেই যেন পাকিস্তানের পূর্বাংশের স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয় সেজন্য আগেই সতর্কবার্তা প্রেরিত হয় পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দফতর থেকে। মেজর সিদ্দিক সালিকের গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি থেকে মার্চ-সমাবেশের আগে বঙ্গবন্ধুকে হুশিয়ারি জানানো হয় : পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কথা বললে এর কঠোর জবাব দেয়া হবে। বাঙালি হত্যার উদ্দেশে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র-ট্যাঙ্ক-কামান-মেশিনগান প্রস্তুত রাখা হয়। ৭ মার্চের জনসভায় কী বলা হবে সে সংক্রান্ত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা অথবা আলোচনার দরজা খোলা রাখা এ দুই ধরনের মতামতই প্রকাশিত হয়। ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের চরম মতাদর্শী অংশ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে চাপ দেয়। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু মূলত অনুসরণ করেন তার সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিবের অনুরোধ : ‘আল্লাহর নাম নিয়ে তোমার মন-দিল-অন্তর থেকে যা আছে তাই বলে দিও।’ সেদিন তা-ই বলেন তিনি, যা তার জন্য স্বভাবসম্মত ও সুন্দর। বাঙালির মুক্তিচেতনায় তখন স্লোগান আর স্লোগান : ‘জয় বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা, যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ- বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। এ-ই ছিল তখনকার বাংলা ভূখণ্ডের উত্তাল জনসমুদ্রের ভাষা। বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত পরিসরের ভাষণে কালের পটচিত্র জ্বলজ্বল করে ওঠে। এ এমন এক ‘ভিজুয়ালাইজেশন’ যাতে তখনকার পুরো পরিস্থিতি উপস্থিত জনতার চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ থেকে তারা তাদের করণীয় ভূমিকার চিত্রটিও মনে মনে ঝালিয়ে নিয়ে জনমুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘অ্যালিগোরি’ বা আলঙ্কারিকতায় তার বক্তব্য বহুস্বরিক হয়ে ওঠে; কিন্তু যেখানে যা বলা দরকার তা-ও তিনি সোজাসাপ্টা বলতে ভোলেন না- তিনি তার নিজ ভূমিকা, অবস্থান ও মনোভাব স্পষ্ট করে তোলেন।
বাঙালির অধিকার আদায়ের ন্যায্য দাবি মেনে নেয়া পাকিস্তানি শাসকচক্রের পক্ষে ছিল অসমম্ভব। ফলে স্বতন্ত্র স্বাধীনরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পর্ব আসন্ন হয়ে পড়ে। অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সর্বাত্মক সংগ্রামের সূত্রপাত। বাঙালির মনে আন্দোলনের ডাকে অভিনব সাড়া জাগে, কারণ বঙ্গবন্ধুর মুখে উচ্চারিত হয় জনপ্রাণের ভাষা। সেদিনের সকালেই মানুষ প্রস্তুত হয়ে ছিল, স্বাধীনতার দ্রষ্টা-রূপকারের গলায় কখন শুরু হবে স্বাধীনতার ডাক! তাকে যে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বলা হয়, সেটা এজন্য যে, সেদিন তিনি যে ভাষণ দেন তা ছিল এক মহৎ কবিতা। কবিতার স্বাভাবিক শক্তিতে একটি রাষ্ট্রের জন্মদানের মতো এত বড় কাণ্ড সচরাচর ঘটে না। আকরিকের শক্তিতে ভরা তার ভাষণের ভাষা। তাতে ইঙ্গিত ছিল, কৌশল ছিল, অভিনব কূটনীতি ছিল, যার পুরোটাই সুবুদ্ধি ও সুচিন্তায় সমৃদ্ধ। ভাষণে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের ভূমিকা সম্পর্কেও তিনি আলোকপাত করেন। এর বিশেষ দিকগুলো হচ্ছে, তিনি এতে সামরিক আইন প্রত্যাহারের আহ্বান জানান; সেই সঙ্গে অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মোকাবেলার হুমকি দেন শত্রুপক্ষকে। তার ভাষা টানটান, সন্দেহ নেই; কিন্তু এমন এক ‘টোনে’ তিনি কথা বলেন যে, এর জবাবে বিরোধী চক্রের পক্ষে প্রতিক্রিয়ার ভাষাটি নির্ধারণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তানে নিরন্তর হরতাল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে নিগ্রহ-আক্রমণ প্রতিরোধের আহ্বান জানান।
এর আগে ঊনসত্তরের ৫ ডিসেম্বর তার হাতে তার প্রিয় জন্মভূমির ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ হয়, যা আমাদের একমাত্র আশ্রয়, জীবন ও স্বপ্নের শেষ আশ্রয়। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের সূচকরূপে চিহ্নিত যে ভাষণ তার প্রবক্তার রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। নিজ ভূমির সর্বস্তরের বাসিন্দার জন্য তার ভালোবাসা কত যে গভীর তা বোঝা যায় যখন তিনি বলেন : ‘ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে... ওই শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।’ যে মহান মানুষ তার নিজের জীবনটাই পেতে দেন সাধারণ মানুষের মঙ্গল-মুক্তির প্রত্যাশায়, তার পক্ষে আদৌ কি সম্ভব শহীদের রক্ত মাড়িয়ে অ্যাসেম্বলিতে যোগ দেয়া! ভাষণে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা ও মানবিক মূল্যচেতনার বিভিন্ন নির্দেশক-চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার মানবিক মহত্ত্ব ও ঔদার্যের পরিচয়ও পাওয়া যায় অনায়াসে; রাজনৈতিক তাৎপর্যের সীমা ছাপিয়ে এ প্রবণতা তার জীবনদর্শনের একটি বিশেষ দিকও বটে। তিনি বলেন : ১. ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না।’ ২. ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’
প্রকৃতপক্ষে রেসকোর্স-ভাষণের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর মুখে উচ্চারিত এই মহাবাণীতে বাংলাদেশের পতাকা-মানচিত্র স্পষ্ট ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর পরিমিতিবোধ ও কৌশলজ্ঞানের উদাহরণও এতে পুরোপুরি উপস্থিত। ‘এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’- এই অংশে ‘মুক্ত করে ছাড়ব’ কথাটায় বৈপ্লবিক অঙ্গীকার থাকলেও তাতে কূটনৈতিক আবরণ ব্যবহৃত হয়েছে, স্বাধীনতার বদলে ‘মুক্তি’ শব্দটি ব্যবহার করে পাকিস্তান ভেঙে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাটি বলা হয় একটু ঘুরিয়ে, কেননা ‘বিদ্যমান রাষ্ট্রের’ ভেতর অবস্থান করে অসতর্কভাবে কথা বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে নেতার জীবননাশ হলে বাংলাদেশের জন্ম দিত কে?
সত্তরের নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত এক বক্তৃতায় মার্চ-ভাষণ ও বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনারা যে ভালোবাসা আমার প্রতি আজও অক্ষুণœ রেখেছেন, জীবনে যদি কোনোদিন প্রয়োজন হয় তবে আমার রক্ত দিয়ে হলেও আপনাদের এ ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করব।’ ১৫ আগস্ট এই ঋণ শোধ করে বাঙালির শ্রেষ্ঠতম নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে যান; কিন্তু আমাদের সঙ্গে থেকে যায় তার আদর্শ, যার আলোতে আমরা পথ চলছি এবং চলব।
মোহাম্মদ আলী আশরাফ : কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ashrafvpbc@gamil.clm

SUMMARY

2218-1.jpg