--------------------------------------
সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে যখন শেখ মুজিবের বিতর্ক হয়, তখন শেখ মুজিবের বয়স মাত্র ২৪ বছর। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে যে তরুণ বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারেÑ ও রিষষ ঢ়ৎড়াব ঃযধঃ ও ধস ংড়সবনড়ফু.’ উপলব্ধি করা যায়, কি প্রচ- আমিত্ববোধ তরুণ শেখ মুজিবের মধ্যে দানা বেঁধে উঠতে থাকে!
শেখ মুজিব তাঁর জীবনকালে রাজনৈতিক কারণে কতবার জেলখানায় বন্দী অবস্থায় কাটিয়েছেন, তা আজ গবেষণার বিষয়। জেলের ভয়ে কখনও তিনি পালিয়ে বেড়াননি। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা পর্যন্ত অধিকাংশ সময় শেখ মুজিবকে জেলের অভ্যন্তরে কাটাতে হয়েছে। শেখ মুজিবের সমালোচকরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি না পালিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু পালানোর ব্যাপারটি যে শেখ মুজিবের চরিত্রেই ছিল না, সেটি জেনে রাখা প্রয়োজন। এটি তাঁর জীবন দর্শন। আর এই জীবন দর্শনের উন্মেষ ঘটে তাঁর ছোটবেলা থেকেই। প্রসঙ্গক্রমে একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। শেখ মুজিবের বয়স যখন ১৮ বছর, সেই সময় মালেক নামের শেখ মুজিবের এক বন্ধু হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়। বন্ধুকে উদ্ধার করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মারপিটের ঘটনা ঘটে যায়। বিষয়টি নিয়ে প্রতিপক্ষ থানায় এজাহার দায়ের করে। এজাহারে আসামি হিসেবে যাদের নাম থাকে, তাদেরকে গ্রেফতারের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। শেখ মুজিবকে জানানো হয় গ্রেফতারের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে কিছু সময়ের জন্য বাড়ি থেকে সরে যেতে হবে। শেখ মুজিবের ভাষায়Ñ ‘আমার ফুফাতো ভাই, মাদারীপুর বাড়ি। আব্বার কাছে থেকেই লেখাপড়া করত, সে আমাকে বলে, ‘মিয়া ভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না।’ আমি বললাম, ‘যাবো না, আমি পালাবো না, লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি।’ ১৮ বছরের মুজিব গ্রেফতারের ভয়ে বাড়ি থেকে সেদিন পালিয়ে যেতে যেমন রাজি হননি, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা যখন তাঁকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তখনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উত্তর ছিলÑ ‘আমি পালাবো না’। শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য যখন তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়ি ঘিরে ফেলা হয় এবং প্রচ-ভাবে আক্রমণ শুরু হয়ে যায়, তখন সামরিক বাহিনীর জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনÑ ‘আমি পালাবো না’। তিনি শুধু পালাননি তাই নয়, বরং অসীম সাহসিকতার সাথে তিনি ঘাতকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। লক্ষণীয়, ঘাতকের গুলি তাঁর বুকে লেগেছিল, পেছনে নয়। মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তাঁর নীতিতে অটল থেকেছেনÑ ‘আমি পালাবো না’। এখানেই বঙ্গবন্ধুর আমিত্বের বিশেষত্ব, এরকমই বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। এই অহংবোধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য।
বঙ্গবন্ধুর আমিত্ব বা অহংবোধ নিয়ে একটি বিশাল গ্রন্থ রচিত হতে পারে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখে রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, সেই ভাষণে তাঁর আমিত্বের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। একজন রাজনৈতিক নেতার ভাষণ শুনে শ্রোতা-সাধারণ উদ্বেলিত হয়, আবেগাচ্ছন্ন হয়ে বলে ওঠেÑ নেতা তার মনের কথা, হৃদয়ের আকাক্সক্ষার কথা প্রকাশ করেছেন, তখন নেতার সঙ্গে কর্মীর কোন রকম ব্যবধান থাকে না। নেতার সুর এবং কর্মীর কণ্ঠস্বর তখন মিশে একাকার হয়ে যায়। প্রসঙ্গক্রমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের ব্যাপারে আমাদের দেশের বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা মূলত অসাধারণ রাজনৈতিক নেতা বলেই বিবেচনা করে থাকি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন, নির্মলেন্দু গুণ সে ভাষণটিকে একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য লাখ লাখ শ্রোতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : কখন আসবে কবি? ...
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ভবিষ্যতে মহাকাব্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া অসম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ইতিমধ্যেই উচ্চারিত হয়েছে, তিনি প্রকৃত অর্থে একজন ‘রাজনীতির কবি’ (চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং)।
৭ মার্চের ভাষণ প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া আর কিছু নয়। এটি তাঁর নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণ বলে যেমন চিহ্নিত হয়, তুলনামূলকভাবে সমগ্র বিশ্বজুড়ে এমন ভাষণ আর নেই বলে গবেষকদের অভিমত। উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর আমিত্বের প্রকাশ কিভাবে ঘটেছে, ভাষণে কতবার তিনি ‘আমি’ ‘আমার’ এবং ‘আমাকে’ বিষয়ক শব্দ ব্যবহার করেছেন, সেদিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে ভাষণ শুরু করেন। এটি ব্যতিক্রমধর্মী সম্বোধন। শুরুতে বলেছিলেনÑ ‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। ...আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।...নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন।...আমি শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। ...আমি বললাম, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো, এমন কি আমি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। ...আমি বললাম, এ্যাসেম্বলি চলবে। তারপর হঠাৎ ১ তারিখে এ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসাবে এ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন, আমি বললাম যে, আমি যাবো। ...তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। ...আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কল-কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। ...আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী-আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে। ...টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জনাব এহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপরে গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন’।
বক্তৃতার মাঝামাঝিতে এসে আবার তিনি উচ্চারণ করেছেনÑ ‘ভাইয়েরা আমার। ২৫ তারিখে এ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। এ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম।’ এরপর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু ক্রমেই কঠিন অবস্থানে চলে যেতে থাকেন, কঠিন কর্মসূচী ঘোষণা করতে থাকেন। যেমনÑ ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে বাংলাদেশে কোর্ট, কাচারি, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য অন্য যে জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না।...এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটি গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল: প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। ...তোমরা আমার ভাইÑ তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। ...যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন।...সরকারী কর্মচারীদের বলি; আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয় খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হবে। কেউ দেবে না।’
১৮ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু মোট ৪০ বার ‘আমি’ ‘আমার’ এবং ‘আমাকে’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। শব্দটি ঘন ঘন উচ্চারণ করলেও শ্রোতাদের কাছে বিরক্তিকর হয়নি, বরং শ্রুতিমাধুর্য বেড়ে গেছে এবং আরও হৃদয়স্পর্শী হয়েছে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাড়া এত ‘আমি’ শব্দের ব্যবহার বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছাড়া অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধুর আমিত্বের মধ্যে আত্মভোগের চিহ্নমাত্র নেই, আছে দেশের মানুষের কল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করবার বলিষ্ঠ অঙ্গীকার। আছে আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়। কাজেই আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ‘আমিত্ববোধ’ আত্মত্যাগের মহিমায় চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।
(সমাপ্ত)
লেখক : নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়