৭ই মার্চের ভাষণ : ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’

৭ই মার্চের ভাষণ : ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’
ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম
 
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা আজ পুনরায় এক ভিন্ন দ্যোতনায় আন্দোলিত হলাম, আনন্দিত হলাম, প্রবল এক আবেগে আপ্লুত হলাম। আপ্লুত হলাম বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের সেই ভাষণ বাঙালির আত্মমুক্তির মন্ত্ররূপে একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজ তা আবার বিশ্বমানবের মুক্তির মন্ত্ররূপে গৃহীত, বিশ্বের সর্বত্র অবিস্মরণীয় ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায়। এমন আনন্দের সংবাদে আমরা আপ্লুত না হয়ে পারি না।

আপ্লুত হওয়ার আরো কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- ৭ই মার্চের এই ভাষণসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অনেক বক্তব্য-ভাষণ, অনেক কথা এই ভূগোল-বাংলায় উচ্চারণ করাও ছিল প্রায় দেশদ্রোহিতার শামিল! এককথায়, ১৯৭৫ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে এই নিষ্ঠুর নির্মমতাই ছিল বাঙালির অনিবার্য নিয়তি। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালি সেই নিয়তিকে কোনমতে এড়িয়ে যেতে পারেনি, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সেবছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বাঙালির ললাট থেকে কালিমাময় ভ্রান্ত ইতিহাসের অপনোদন ঘটতে শুরু করে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নতুন যুগের সূচনায় ঐতিহাসিক নানা দালিলিক প্রামাণ্য আমাদের সম্মুখে উন্মোচিত হতে শুরু করে। তাই এবার ইউনেস্কো যখন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তখন আমাদের নানা কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে কী ভয়ংকর এক অন্ধশক্তির অপশাসনের খপ্পড়ে আমরা পড়েছিলাম! সেইসাথে আমাদের এই জাতিরাষ্ট্র এক মিথ্যা ইতিহাসের চোরাবালির মরীচিকায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল!

মনে পড়ে দীর্ঘ ২১টি বছর সেনা-ছাউনিজাত অপশাসনের নিগড়ে নিমজ্জিত হয়ে আমরা সত্যভাষণ উচ্চারণেও কী পরিমাণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম! কথায় বলে ‘আগুন কখনো ছাইচাপা দিয়ে রাখা যায় না’। অবশেষে তাই প্রমাণ হলো। কেবল বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের সর্বত্রই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের এই ভাষণ উচ্চারিত হবে। বিশ্ববাসী বঙ্গবন্ধুর এই মহান ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে চিনতে পারবে। তাই নানা কারণে আজ আমরা আবেগপ্রবণ ও আনন্দে আপ্লুত।



১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিকামী বাঙালির উদ্দেশ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ প্রদান করেছিলেন তা সেসময় সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বাঙালির ঐক্যবদ্ধতার সেই বাস্তব রূপটি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিল। তাঁর উদাত্ত আহ্বানে মুক্তি পিপাসু ঐক্যবদ্ধ বাঙালি সেদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠতে কালবিলম্ব করেনি। বঙ্গবন্ধুর সেই অমোঘ আহ্বান সামগ্রিকভাবে বাঙালি জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল।

৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ মাত্র এই ক’টি দিন! মহান সেই ভাষণের মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালির মিলিত ঐক্য মাত্র ক’দিনেই সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রকাশ করে তুলেছিল। লাখ লাখ বাঙালি তরুণ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র আপামর মেহনতি জনতা দুষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ তথা সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণের জন্য নাম লেখায় দ্বিধাহীন চিত্তে। বঙ্গবন্ধুর উদার আহ্বান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ পৌঁছে গিয়েছিল জাতির প্রতিটি মানুষের রক্ত প্রবাহের অণুতে-পরমাণুতে।

বাঙালি তার তেজদীপ্ত শৌর্য ও বীর্যের হুংকারে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। প্রকৃত পক্ষে ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শুরু হয়ে যায় বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। ২৫ মার্চ ভোর রাতে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করার আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সবাইকে সশস্ত্র যুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ার বার্তা দিয়ে যান। বন্দি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে। কিন্তু লাখ লাখ বীর বাঙালির প্রেরণায় ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণসহ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। মরণপণ সংগ্রামে তরুণ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র আপামর মেহনতি জনতা মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে মাত্র নয়মাসে মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করেন।

১৬ই ডিসেম্বর বাঙালির বিজয় সূচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা পেয়ে যাই লাল-সবুজের পতাকা। আমরা গৌরবান্বিত হই স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করার ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে। যার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ‘ভাষণ’ কেবল কতগুলো শব্দগত উচ্চারণমাত্র ছিল না। সেই ভাষণ ছিল বাঙালির আত্মআবিষ্কারের দর্শন, দিগনির্দেশনা। তাই ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ বাঙালি জাতির অহংকারের ধন। বাঙালির অহংকার থেকে মহামানবের মহান সেই ভাষণ এখন মানব ইতিহাসের অহংকাররূপে প্রতিষ্ঠিত।

ইউসেনেস্কো সম্প্রতি ‘মেমোরি অব দ্য ওর্য়াল্ড’ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে স্বীকৃতি দেওয়ায় বিশ্বসভায় আরো একবার বাঙালিকে গৌরবান্বিত করলেন বঙ্গবন্ধু। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে কতভাবেই না ঋণী করেছেন! বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন বলেই আজ আমরা একটি স্বাধীন দেশের অহংকার করতে পারি, স্বাধীনভাবে ভাবতে পারি, স্বাধীনভাবে স্বপ্ন দেখতে পারি। বঙ্গবন্ধুর কল্যাণে পাকিস্তানিদের নিকট থেকে আমাদের পরাধীনতার যেমন মুক্তি ঘটে তেমনি তাঁর সকল কর্ম, কথা, বক্তব্য ও ভাষণে আমাদের চিত্তেরও মুক্তি ঘটেছিল। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুই ছিলেন আমাদের সার্বিক মুক্তির দিশারী।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ইউনেসকোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা ইউনেস্কোর সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাই আরো ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশের যারা এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট থেকে নিজেদেরকে গৌরবের অংশীদারে পরিণত করেছেন।

সমগ্র বিশ্ববাসীর অহংকারের ধনে পরিণত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ- কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় ‘অমর কবিতাখানি’। ৭ই মার্চের ভাষণ প্রকৃত অর্থেই এক অসাধারণ কবিতা। এই কবিতার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদস্পন্দন প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল। অথচ আমরা এমন কত দিন, বছরের পর বছর কত দীর্ঘ দিবস, কত দীর্ঘ রজনী পার করে এসেছি যে সময়টাতে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বাজিয়ে শোনার অনুমতি পেতাম না।

শুধু ৭ই মার্চের ভাষণই নয়- বঙ্গবন্ধুর সকল বক্তৃতা-ভাষণ এমন কি কথোপকথনও শোনার অবকাশ ছিল না বাঙালির। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃতির সামরিক-বেসামরিক যে প্রতাপ ও শক্তির প্রয়োগ দেখেছি তাতে সাধারণের পক্ষে কখনো সম্ভব হয়ে উঠেনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনবার। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ সঞ্চারকারী ও বহুল উচ্চারিত স্লোগান ‘জয় বাংলা’ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছিল দিনের পর দিন। মহামানবের মহৎ এসব বক্তব্য-ভাষণ সাধারণের জন্য ‘নিষিদ্ধ’ করে বাঙালিকে এক ভ্রান্ত ইতিহাসের কানাগলিতে নিক্ষেপ করেছিল সামরিক-বেসামরিক রাষ্ট্রযন্ত্র। কিন্তু ইতিহাস তার স্বীয় শক্তি ও তেজে আপনিই প্রকাশিত হয়- তা আবারো প্রমাণ হলো। আর আমরা পুনরায় গর্বিত হলাম ৭ই মার্চের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অমর কবিতা’ ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায়। পুনরায় বলি আমরা আনন্দিত, আমরা সতত আবেগে আপ্লুত।- ‘জয় বাংলা’।

SUMMARY

2215-bb3.jpg