জাতির উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ অনন্ত মহিমায় ভাস্বর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা সৃষ্টিকারী ভাষণগুলোর অন্যতম ৭ মার্চের ভাষণ। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালী জাতিসত্তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানুষের মর্যাদা নিয়ে বিশ্বসভায় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়েছে এই ভাষণে। গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ১৮৬৩ সালে প্রদত্ত বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনামূলক ৭ মার্চের এই ভাষণ।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেক্ষাপটে রয়েছে বাঙালী জাতির সুদীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও রক্তদানের গৌরবময় ইতিহাস। উদার মন ও বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশবাসী তাঁর একান্ত আপনজন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বিশাল জনসভায় সমবেত মুক্তিপাগল দেশবাসীকে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে তিনি সম্বোধন করেন। ভাষণের শুরুতে দৃঢ়কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়।’
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের উল্লেখ করে আবেগ উদ্বেলিত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে। আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এই দেশকে গড়ে তুলব...। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, গত ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস...।’ ইতিহাস সচেতন বঙ্গবন্ধু বক্তব্যের জের টেনে বলেন, ‘১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ২১-দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে, ১৯৬৬ সালে ৬-দফার আন্দোলনে, ৭ জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকারে ছিলেন তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়Ñপাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না।’
বাঙালী জাতির স্বার্থ সংরক্ষণে ৬-দফা অনুযায়ী পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবিতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অটল। ঐতিহাসিক ৬-দফা বাঙালী জাতির মুক্তির ‘ম্যাগনাকার্টা’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ৬-দফায়। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান ৬-দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে হুমকি দিয়েছিল ‘অস্ত্রের ভাষায় ৬-দফা দাবির জবাব দেয়া হবে।’ ৬-দফা দাবি বাংলার গণমানুষের হৃদয় জয় করতে থাকলে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপন করে দায়ের করা হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।’ শাসকের ষড়যন্ত্রের কাছে মাথানত করেননি বঙ্গবন্ধু। প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশবাসী। ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন রূপান্তরিত হয় গণঅভ্যুত্থানে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। জাতির মুক্তির প্রশ্নে নির্ভীক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে ছাত্রসমাজ। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরে দাঁড়ান জেনারেল আইয়ুব। বঙ্গবন্ধুর দাবি অনুযায়ী জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধু।
শুরু হলো ষড়যন্ত্র। ৬-দফার বিরোধিতা করে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষমতা দাবি করলেন পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টোর বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘৬-দফা পরিবর্তনের কোন অধিকার আমার নেই। এটা জনগণের সম্পদ।’ ভুট্টো ঘোষণা দিলেন ন্যাশনাল এসেমব্লির অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন মেম্বারকে যোগদান করতে দেয়া যাবে না। কেউ যোগদান করলে কসাইখানা হবে এসেমব্লি। এরপর ১ মার্চ (১৯৭১) এসেমব্লির অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জনাব ইয়াহিয়া সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। দেখে যানÑ কিভাবে আমার গরিবের ওপরে, বাংলার মানুষের বুকের ওপরে গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কিভাবে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’ ১০ মার্চের রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগদান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি, কিসের আরটিসি? কার সঙ্গে বসব। ৩ (মার্চ) তারিখ পল্টনে আমি অসহযোগের আহ্বান জানালাম। বললাম অফিস-আদালত, খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করেনÑ আপনারা মেনে নিলেন। হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে একজনের (ভুট্টো) সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি (প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান) করেছেন তাতে সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন।’
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘২৫ মার্চ তারিখে ইয়াহিয়া খান এসেমব্লি কল করেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই।... শহীদের রক্তের ওপর পা দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এসেমব্লি কল করেছেন। আমার দাবি মানতে হবে। প্রথমে সামরিক আইন (মার্শাল ল’) উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব এসেমব্লিতে বসতে আমরা পারব কি পারব না।’
তাঁর প্রতি আস্থা আছে কিনা বঙ্গবন্ধু সে কথা জনতার কাছে জানতে চাইলে মুক্তিকামী লাখো জনতা হাত উঠিয়ে আস্থা জ্ঞাপন করে। বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের প্রতি অসহযোগিতার আহ্বান জ্ঞাপন করে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত, ফৌজদারি আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না।... ২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন।’ পাকিস্তান সরকার এরপরও বাঙালীর আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবির বিরোধিতা করতে থাকলে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এরপরে যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা আছে, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ সরকারী কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশ দান করে তিনি বলেন, ‘সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার দেশের মুক্তি না হয় খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো।’ ঐক্যে বিজয়, বিভেদে পরাজয়। হিন্দু-মুসলমান, বিহারী, বাঙালীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির অপচেষ্টা সম্পর্কে তাই সতর্ক থাকার জন্য বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, মিছিলের মধ্যে আন্তকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী, নন-বাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়।... যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝে-শুনে কাজ করবেন।’ বাঙালী জাতিকে সকল দিক থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জ্ঞাপনের জন্য ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ হিসেবে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত। সেইদিন সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার চূড়ান্ত মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষাকেই মূর্ত করেছেন ৭ মার্চের ভাষণে। ৭ই মার্চের (১৯৭১) ভাষণের এটিই ঐতিহাসিকতা।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঐতিহাসিক তাৎপর্যম-িত। আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ এড্রেসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা করা হয়। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ (অলিখিত এবং স্বল্প সময়ের) বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ। এর আগে আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ এ্যাড্রেস বিশ্বের সেরা ভাষণ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ১৯ নবেম্বর, ১৮৬৩ স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদ যোদ্ধাদের উদ্দেশে জাতীয় সৈনিক সমাধিক্ষেত্র উৎসর্গকরণ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘গেটিসবার্গ এ্যাড্রেস’ খ্যাত ভাষণটি ছিল লিখিত এবং পরিসর ছিল সীমিত। যার সারমর্ম ছিল জনকল্যাণ করতে পারে ‘জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার, যা পৃথিবী থেকে ধ্বংস হবেই না।’
৭ মার্চের জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির বিষয়বস্তু আরও অনেক বেশি ব্যাপক। রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ কূপম-ূকতা থেকে মুক্ত করার দিকনির্দেশনা সুদূরপ্রসারী অঙ্গীকার। কাব্যিক কৌশলে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বিতীয় নজির পাওয়া যাবে না। ঘবংিবিবশ পত্রিকার ৭ এপ্রিল ’৭১ সংখ্যায় ভাষণটির জন্যে বঙ্গবন্ধুকে Poet of politics আখ্যায়িত করেছিল।
লেখক : শিক্ষাবিদ, ভাষাসৈনিক