মনসুর মুসা
এই ভাষণের ভাষিক তাৎপর্য নিয়ে প্রচুর চিন্তার অবকাশ রয়েছে। সংক্ষেপে এ কথা বলা যায়,যখন কোনো ভাষক ও ভাষিত, অর্থাৎ বক্তা ও শ্রোতা বোধের একই সমান্তরাল অবস্থানে থাকে, তখন তাঁদের মধ্যে যে সংজ্ঞাপন নিষ্পন্ন হয়, তা হতে পারে যুগান্তকারী।
এই অভিভাষণটি ছিল একটি বৈকালিক অভিভাষণ। একজন উত্তম পুরুষ, শেখ মুজিব ছিলেন এর উৎস। আর এই ভাষণের মধ্যম পুরুষ ছিলেন রমনা রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত কয়েক লাখ মানুষ। উত্তম পুরুষের লক্ষ্য ছিল এই লাখ লাখ মানুষের মনে সংগ্রামী চেতনা সঞ্চালন। এই ভাষণের একজন ভাষ্যকারও মধ্যম পুরুষের একজন ছিলেন; আর ছিলেন সমগ্রদেশের অগণিত প্রথম পুরুষ। উত্তম পুরুষ আর মধ্যম পুরুষ সংজ্ঞাপনের নিয়ম অনুযায়ী পরস্পরের দিকে মুখ করে বাচিক ক্রিয়া (কথন+শ্রবণ) সম্পন্ন করেছিলেন। এই ভাষণ নোয়াম চমস্কির ‘কালারলেস গ্রীন আইডিয়াজ স্লিপ ফিউরিয়াসলি’র মতো সঞ্জননী বাক্য ছিল না। এটি একটি প্রাণান্তকর ভাষণ, যেখানে ‘যদি আমি হুকুম দিবার নাও পারি’র মতো অসমাপ্ত উপবাক্য ছিল। বেশ কয়েকটি মনোভাঙ্গি পরিবর্তনের ‘বিরাম’ ছিল, অসমাপ্ত বাক্যে সংলগ্নতার ভাব ছিল, আরো ছিল ঠারবাক্য, ইঙ্গিতবাক্য, সতর্কবাক্য। পুনরোক্ত বাক্যও ছিল।
এই ভাষণের দুটি প্রতিক্রিয়ার কথা জানা যায়। একটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, যা ঘটেছিল মধ্যম পুরুষের মনের মধ্যে- স্বাধীনতা ঘোষিত হলো কি হলো না। কিন্তু প্রথম পুরুষ, যাঁরা রমনায় উপস্থিত ছিলেন না, তাঁদের মধ্যে, তাঁদের মনের মধ্যে ঘটেছিল অন্য ক্রিয়া। সেটা হচ্ছে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ আর নয়, ‘জয় বাংলা’ এখন থেকে। পরিণামে শুরু হয়ে গেল নতুন পতাকা উত্তোলনের সাংকেতিক কর্মপ্রবাহ। ২৩ শে মার্চে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। পত্রিকায় খবর এসেছে। তারপর ২৫ শে মার্চের কালরাত্রি। কালো রাত্রি না; জ্বলন্ত ও রক্তাক্ত রাত। এই অভিভাষণ, পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল হান্নানের ভাষণে, মেজর জিয়ার ভাষণে, শেষ পর্যন্ত মুকুলের চরমপত্রে। একটি ভাষণ থেকে বেরিয়ে এসেছিল একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ধ্বনিগুচ্ছ – বাঙালি। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান – সবার এক পরিচয়। ভাষণের বাক্যগুলো সঞ্জননী ছিল না; ছিল সঞ্জীবনী। প্রথাগত ব্যাকরণের নিয়মে এই ভাষণ ব্যাখ্যা করা দুঃসাধ্য, তবে অসাধ্য নয়। কারণ,আব্রাহাম লিংকনের ভাষণটি ছিল লিখিত ও পঠিত। পুরো এক দিন চিন্তা করে করে তিনি সেটা লিখেছিলেন। শেখ মুজিব, যতদূর মনে পড়ে, তাৎক্ষণিকভাবেই ভাষণটি দিয়েছিলেন; কোনো নোট হাতে ছিল বলে মনে হয় না। যাঁরা তাঁর ডানে-বামে, সামনে – পেছনে ছিলেন, মঞ্চে ছিলেন, নীচে ছিলেন, গাছের ডালে ছিলেন, তাঁরা দেখেছেন কিনা জানি না্ অভিসন্দর্ভ বিশ্লেষণ (ডিসকোর্স অ্যানালিসিস)যাঁরা করেন, তাঁরা ‘পাঠ – বিশ্লেষণ’ ও ‘ভাষণ-বিশ্লেষণ’ -এর পার্থক্য বোঝেন।
পাঠ-বিশ্লেষণে সুগঠিত বাক্য সংরক্ষণ করা সহজ, কিন্তু ভাষণ বিশ্লেষণে তা সর্বত্র রক্ষিত হয় না। উহ্য থাকে, ইশারা থাকে, ভঙ্গুরতা থাকে, প্রস্বরের উত্থান-পতন থাকে। অ্যাকুস্টিক ধ্বনিতত্ত্ব ব্যতীত ভাষণটির ধ্বনি-অতিরেক বৈশিষ্ট্যগুলো নির্দেশ করা সহজ নয়। সেই কাজ ভাষাবিজ্ঞানী করতে পারলে উপকার বৈ অপকার হবে না। ভাষিক উচ্চারণের শক্তি পরিমাপের একটি বৃহৎ সূত্র আবিষ্কার করাও সম্ভব হতে পারে।
রাজনৈতিক তাৎপর্য
১৫০ টি শব্দ একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্মকে সম্ভাবিত করেছে, একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের অবসান ঘটিয়েছে। সমগ্র বিশ্বকে বাাংলাদেশের জনগণের শক্তির দিকে আকর্ষণ করেছে। এই ভাষণ বহুযুগ পুনরাবৃত্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই ভাষণের রাজনৈতিক তাৎপর্য বহুবিধ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলবেন, মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে ভিয়েতনাম যেমন বৃহৎ শক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অর্জন করা স্বাধীনতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাও তেমনি বৃহৎ শক্তিবর্গের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অর্জন করা একটি স্বাধীনতা। বৃহৎ শক্তির প্রতিরোধাত্মক কারণ হলো কূটনৈতিক, আর বাঙালির সংগ্রাম ছিল নৈতিক।
ধর্মীয় আবেগের অন্ধগতিকে ব্যবহার করে একটি প্রশাসন কিভাবে মানুষের ন্যায়সঙ্গত বাঁচার অধিকার বিপর্যস্ত করে, তারও দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ৭ই মার্চের ভাষণ সংক্ষিপ্ত ভাষণ, কিছুটা বিক্ষিপ্ত ভাষণ। কিন্তু এর মধ্যে শব্দ চয়নে আছে সুতীক্ষ্ণতা, উপবাক্য গঠনে রয়েছে সতর্কতা। আর বাক্যগুলো নিটোল অর্থপূর্ণ। সবশেষে ভাষণটির মর্মার্থ হচ্ছে -স্বাধীনতা শুধুই স্বাধীনতা; আর কিছু নয়।