৭ মার্চের বার্তা ও তার শিক্ষা-সৈয়দ আবুল মকসুদ


আমাদের কাছাকাছি বয়সের যাঁরা এবং সেদিন ঢাকায় ছিলেন, বিশেষ করে ওই দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা তার আশপাশে ছিলেন, তাঁদের সেই দিনটির কথা অম্লান থাকবে আমৃত্যু। আজ থেকে ৪৬ বছর আগের সেই সাতই মার্চ। যেদিনটির পরে বাঙালি আর আগের মতো রইল না। আমূল পরিবর্তন আসে তার মনোজগতে। এক নতুন প্রত্যয়ে সে উজ্জীবিত হয়। যতটা সাহস তার আগে ছিল, ওই দিন থেকে আরও সাহসী ও প্রত্যয়দীপ্ত হয়ে ওঠে।
কিছুকাল যাবৎ ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর এবং ৭ মার্চের ভোরবেলা থেকে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণের রেকর্ড বাজানো হয়। সেই সঙ্গে কোথাও ভোজের আয়োজনও হয়। তা তেহারিই হোক বা অন্য কিছু হোক। কিন্তু ওই দিনটির তাৎপর্য ও শিক্ষা নিয়ে আদৌ কেউ ভাবেন কি না, সেটা সত্যিই এক বড় প্রশ্ন। ওই দিনটি ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্যে রয়েছে জাতীয় রাজনীতির বহু শিক্ষার উপাদান।
যাঁরা একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং জাতির নির্মাতা, তাঁদের জীবন ও কর্ম থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্মের শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে বহু কিছু। সেই শিক্ষা যারা নিতে চায় না, সেই জাতি হতভাগ্য। তাদের অতীত আছে, কিন্তু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেই। বাংলাদেশের মানুষের আর কিছু না থাক, তাদের একটি গৌরবের অতীত রয়েছে।
প্রাচ্যের একটি বড় ধরনের বেইমান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ এক ঘোষণায় ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। সেটা করেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর দাবিতে। সারা পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির একটি প্রস্তুতিমূলক সভা হচ্ছিল হোটেল পূর্বাণীতে। আমি সিকান্দার আবু জাফরের সমকাল অফিসে বসা ছিলাম। রাস্তায় হইচইয়ের আওয়াজ শুনে বেরিয়ে দেখি বিভিন্ন দিক থেকে মানুষ পূর্বাণীর দিকে যাচ্ছে। আমিও গেলাম। ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক ও জনতার উদ্দেশে বললেন: ‘জাতীয় সংসদের স্থগিতের ঘোষণা এক সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি। একটি মাইনরিটি দলের একগুঁয়ে দাবির কারণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষিত হয়েছে। জনগণের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে, তাই আমরা একে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিতে পারি না।’
যত বড় দলই হোক তার নেতা দলীয় নেতা থেকে জাতীয় নেতা হয়ে ওঠেন যখন অন্য দল ও ভিন্নমতের মানুষও তাঁর নেতৃত্বে আস্থা রাখেন। অন্যদিকে জাতীয় স্বার্থে খুব জনপ্রিয় নেতাকেও অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতে হয়। ইয়াহিয়ার দায়িত্বজ্ঞানহীন ঘোষণার প্রতিবাদে একটি গণতান্ত্রিক দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথ বেছে নেন। ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে সাধারণ হরতাল আহ্বান করেন। এবং সেই ঘোষণা দিয়েই তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি মাওলানা ভাসানী, জনাব নুরুল আমিন, প্রফেসর মোজাফফর আহমদ এবং জনাব আতাউর রহমান খানের সঙ্গে আলোচনা করব। আগামী ৭ মার্চ রেসকোর্সে এক গণসমাবেশে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’ [দৈনিক পাকিস্তান, ২ মার্চ ১৯৭১ ]
‘আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার’ ও ‘সাতই মার্চ’ কথা দুটি মানুষের কানে ঢুকে যায় এবং মুক্তিকামী মানুষ প্রহর গুনতে থাকে রুদ্ধশ্বাসে। ৭ মার্চের আগের তিন-চার দিন জনগণের প্রস্তুতি চলে। ২ মার্চ ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সামরিক জান্তা সান্ধ্য আইন জারি করে। জনগণ তা অগ্রাহ্য করে। মিছিলে মিছিলে উত্তাল সারা দেশ।
৩ মার্চ ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে বড় জনসভা করে। সেখানে ছাত্রনেতারা স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে চাপ দেন। কিন্তু তিনি একজন সংসদীয় নেতার ভূমিকা পালন করেন। ওই সভায়ও কবি শামসুর রাহমান ও আমি উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই কয়দিনের মধ্যে সরকারের মনোভাব যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে ৭ই মার্চ আমি আমার যা বলার তা বলব। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে দাবি আদায় করতে চাই।’
৭ মার্চের সেই অবিস্মরণীয় জনসভায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসক ও বাংলার জনগণকে যে বার্তা দেন তা হলো, ‘আমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
আমরা সেই দিনগুলোতে যতটুকু দেখেছি ও শুনেছি, তাতে তিনি শুধু তাঁর নিজের দলের নেতাদের সঙ্গে নয়, ভাসানীসহ অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার প্রমাণ ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে ভাসানীর জনসভা। বিশাল ওই জনসমাবেশ থেকে মাওলানা বলেন, ‘২৫ মার্চের মধ্যে ইয়াহিয়া খান এ দেশের মানুষের দাবি মেনে নিয়ে বিদায় না নিলে শেখ মুজিবুর রহমান ও আমি এক হয়ে স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করব। আমি মুজিবকে চিনি, আপনারা তাঁকে অবিশ্বাস করবেন না।’
৭ মার্চ থেকে বাঙালির মধ্যে একটি ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য সৃষ্টি হয়। দেশ চলছিল শেখ মুজিবের নির্দেশে। সব শ্রেণি ও পেশার মধ্যে সৃষ্টি হয় সংহতির। আনসার, পুলিশ, ইপিআর এবং সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের মধ্যে স্বাধিকারবোধের জন্ম হয়। খালেদা জিয়ার বিএনপি ৭ মার্চ কেন পালন করে না, আমার বোধগম্য নয়। এই দিনটি জিয়াউর রহমানের জীবনের গতি বদলে দেয়—তা তো তিনি নিজেই বলে গেছেন। পয়লা মার্চের পরে মেজর জিয়া ও অনেক বাঙালি সেনা কর্মকর্তার মনে হয়েছিল, ‘কিছু একটা না করলে বাঙালি জাতি চিরদিনের জন্য দাসে পরিণত হবে।’ তাঁর ভাষায়, ‘সম্ভবত ৪ঠা মার্চে আমি ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ডেকে নেই। আমাদের ছিল সেটা প্রথম বৈঠক। আমি তাকে সোজাসুজি বললাম, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে।... ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো।’ [সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ২৬ মার্চ ১৯৭৪ ]
সেদিন বঙ্গবন্ধু সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, কূটনীতিবিদ, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য—সবার মধ্যে একটি আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। সেটাই তাঁর প্রধান গুণ। জনগণও পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছু তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। নেতা জনগণের আবেগকে ধারণ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি যাঁরা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেন, তাঁরা একটু খেয়াল করে শুনলে বা পাঠ করলে লক্ষ করবেন ওই ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য একটি বাক্যও ছিল না। সেখানে পুরোটাই বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মুক্তির কথা। শেখ মুজিব যদি ইয়াহিয়ার কাছে দাবি করতেন বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধিকারের আপাতত প্রয়োজন নেই, আপনি এই প্রদেশে আর তিনটি হাসপাতাল, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, সাতটি কলেজ এবং যমুনার ওপর একটি ব্রিজ বানিয়ে দেন। খুশিতে লাফিয়ে উঠে ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, আলবৎ, শেখ ছাহাব আলবৎ দেব। আপনাদের গণতন্ত্রের প্রয়োজন নেই। মানবিক অধিকার দিয়েই-বা কী করবেন? বাংলার পলিমাটির নরম পথঘাট পাকা করে দেব। গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজের মতো শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করে দেব। স্কুল-কলেজ গড়ে দেব। বড় বড় মসজিদ-মাদ্রাসা বানিয়ে দেব। পাঞ্জাব থেকে বাসমতী চাল পাঠাব পঞ্চগড় ও পার্বতীপুরের মঙ্গাকবলিত এলাকায়। পশ্চিম পাকিস্তানের ইজিপশিয়ান কটনের জামা পরবে বাংলার মানুষ। করাচি, লাহোর, লান্ডিকোটাল গিয়ে আপনারা সস্তায় কেনাকাটা করবেন। আমড়া, কতবেল, বৈচি কোনো ফলই নয়, আঙুর, আপেল, নাশপাতি আসবে পেশোয়ার থেকে ঢাকায়। স্বাধিকারের দরকার কী? বেশি গণতন্ত্র দিয়ে কি আপনাদের পেট ভরবে?
শতাব্দীর পর শতাব্দী অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত বাংলার মানুষ চেয়েছে নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার। তারা চেয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার। বহু পদানত জাতি খেয়ে-পরে বেশ ভালো থাকে। সে ভালো ভালো নয়। অধিকারহীন অবস্থায় সুগন্ধি বাসমতী চালের ভাত খাওয়ার চেয়ে মুক্ত ও স্বাধীন মানুষ হিসেবে মোটা ইরি চালের ভাতই হাজার গুণ ভালো। স্কুল, কলেজ, ব্রিজ, কালভার্ট, মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল ইত্যাদির জন্য কোনো জাতি স্বাধীনতা চায় না। পরাধীন ব্রিটিশ আমলে সেগুলো যথেষ্ট হয়েছে। পাকিস্তানি আমলেও হয়েছে। ৭ মার্চের বার্তা হলো অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা। এবং ৭ মার্চের শিক্ষা হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ ন্যায়সংগত।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।

SUMMARY

2205-1.jpg