ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের বিশ্লেষণ ও তাৎপর্য


লেখার শুরুতেই একটি কথা বলে রাখি, আমার মত নগণ্য ব্যক্তির পক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের বিশ্লেষণ করার মত জ্ঞান নেই। তবু আমাদের নিজেদের জানার প্রয়োজনে আলোচনা করছি। তাই ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন তা ছিলো মূলত বাঙ্গালী জাতির মুক্তির সনদ। এ ভাষণটি ছিল একটি অগ্নিমশাল যা বিস্ফোরিত করেছিলো মুক্তিযুদ্ধের দাবানল, যার সামনে টিকতে পারেনি পাকিস্তানি দাবানল।

বঙ্গবন্ধু এ ভাষণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ ভাষণের মাঝখানে বঙ্গবন্ধু খুব সতকর্তার সহিত ৪টি শর্ত আরোপ করেছিলেন-
(১)মর্শা’ল প্রত্যাহার
(২)সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত নেওয়া
(৩)নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর
(৪)যে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিলো তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা।

এই ৪টি শর্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধু আলোচনার পথ উন্মুক্ত করেন।
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট। এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালীদের একান্ত ও নিজস্ব উচ্চারণ “ভাইয়েরা আমার” বলে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন। একেবারে আড়ম্বরহীন ও বাহুলত্য ছাড়া লাখো জনতার সামনে এমন অন্তরঙ্গ শুধু বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিলো। ভাষণের শুরুই বাঙ্গালীর আবেগকে উসকে দিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করে বলেছিলেন-“আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।

আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়”। বঙ্গবন্ধু বুকভরা ভালোবাসা ও বেদনা নিয়ে বলেছিলেন, “আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমার পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশ রক্ষা করার জন্যে সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের গরীব, দুঃখী আর্তমানুষের মধ্যে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। কার সাথে বসবো যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সাথে বসবো? “মানুষকে হত্যা প্রসঙ্গ এবং সেইসব ঘটনা চিহ্নিত করে বার বার বলেছেন “আমার লোক”-যা মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর উদার ভালোবাসার প্রমাণ।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। তিনি তাঁর ভাষণে বাঙ্গালীকে একান্ত আপন ভেবে “তুমি”সম্বোধন করে বলেছিলেন- “মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ঈনশাআল্লাহ”। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে প্রতিটি বাঙ্গালির শিরায় শিরায় আবেগ আর উত্তেজনার ঢেউ খেলে।

বক্তৃতা শেষ করলেন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। যা মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেন।

কবি নির্মলেন্দুগুণ তাঁর কবিতায় বলেছেন,
“কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠবাণী
গণসূর্য মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার
অমর কবিতাবাণী”।

তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙ্গালীর আবেগ, স্বপ্ন ও আকাঙ্কাকে একসূত্রে গেথে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তা ছিলো বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ, মুক্তির ডাক।

ঐতিহাসিক ভাষণের ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাঙ্গালী জাতির বহুকাঙ্কিত স্বাধীনতা।বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্যে নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের জন্যে অনুপ্রেরণা। পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্যে সংগ্রাম থাকবে ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি মানুষের মনে চিরজাগরুক থাকবে। এ ভাষণটি সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে নবীন প্রজন্ম, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাষ্ট্রনায়ক সবার জন্যে শিক্ষণীয়।

এ ভাষণটি একটি জাতি-জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী সৃষ্টি এক মহাকাব্য।বিশ্ব মানবতার জন্যে অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল বা সম্পদ। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে এটি স্বীকৃত।

জাতি সংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ৩০অক্টোবর, ২০১৭ইং তারিখে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে “বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

দীর্ঘ ৪৬ বছর পর হলেও জাতিসংঘের মত বিশ্বসংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বাধীনতার জন্যে আত্মোৎসর্গকৃত ৩০ লাখ শহীদ আর সম্ভ্রম হারানো ২ লাখ মা-বোনসহ আমাদের সবার জন্যে এটি একটি মহা আনন্দ ও বিরল সম্মানের ঘটনা।

SUMMARY

2204-1.png