৭ মার্চের ভাষণ আসলে স্বাধীনতার মূল দলিল — সৈয়দ আব্দুল্লাহ


সৈয়দ আনোয়ার আব্দুল্লা ॥
(ঐতিহাসিক ৭মার্চ নিয়ে দৈনিক বিবিয়ানা পরিবার আজ মুখোমুখো হয়েছিল জাতীয় ইতিহাসবেতাত্তা বঙ্গবন্ধু গবেষক তরফরত্ন সৈয়দ আব্দুল্লাহর। ৭মার্চ বঙ্গবন্ধু প্রেমি এই কৃতি লেখক হাজির হয়েছিলেন উত্তাল রেসকোর্স ময়দানে। নিজ কানে কাছে থেকে বাংলার অবিসংবাদিত মহানায়ক বঙ্গবন্ধুরর ভাষণ শুনার ও সেই ঐকিহাসিক সময়ের সাক্ষি হতে পেরেছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষনের তাৎপর্য, ঐকিহাসিক পেক্ষাপটেসহ নানান বিষয়ে দৈনিক বিবিয়ানার সম্পাদক ফখরুল ইসলাম চৌধুরী কথা বলেন এই গুনী সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইতিহাসবিদ সৈয়দ আব্দুল্লাহর সাথে)

দৈনিক বিবিয়ানা: স্যার ৭মার্চের ভাষণ নিয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই?

সৈয়দ আব্দুল্লাহ: আসলে এই ৭ মার্চের ভাষণ এতো ঐতিহাসিক আর গুরুত্বপূর্ণ কেন? ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা-ই অন্তর্নিহিত ছিলো। বঙ্গবন্ধু তার এ ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিকামী বাংলার মানুষকে মুক্তির আকাঙ্খায় জাগিয়ে তুলেছিলেন। সেই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের টনকও নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এ ভাষণের মধ্যে আমাদের স্বাধীনতার সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা ছিল। মাত্র ১৯ মিনিটের কালজয়ী ভাষণে রচিত হয় একটি ইতিহাস। অতঃপর ভাষণটি ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লিঙ্গনির্বিশেষে সব বাঙালিকে জয়বাংলার সৈনিকে রূপান্তরিত করেছিল। বাঙালিকে এমন মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল এই ভাষণ, যে তার পক্ষে যুদ্ধ ও স্বাধীনতা এবং ত্যাগ ও বীরত্বের কমে আর কোনো বিষয় নিয়ে ভাবা সম্ভব ছিল না। একটি ভাষণ পুরো জাতিকে এক ধ্যানে মহান ব্রতে উদ্দীপ্ত করেছিল। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে জয়বাংলা ছিল রণধ্বনি, মুজিব ছিলেন মহানায়ক আর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতার অনুপ্রেরণার অফুরন্ত উৎস।

দৈনিক বিবিয়ানা: ভাষণটি আপনার কাছে কতোটা ভাল লাগার পক্তি?

সৈয়দ আব্দুল্লাহ: ৭ মার্চের ভাষণটা কতশত বার শুনেছি, এখনো শুনি। নাতত নাতনিকে নিয়ে বসে মুগ্ধ হয়ে গানের মতো পরম আবেশে আজো বারবার শুনি। কখনো পুরোনো হয় না। যখনই শুনি, গায়ে কাঁটা দেয়। রাস্তাঘাটে যখন চলি, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজতে থাকলে দাঁড়িয়ে পড়ি, শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুনি, শেষ হয়ে গেলে মনে হয়, আরেকবার বাজায় না কেন? বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণটাকে যে কবিতা বলা হয়, তার এটাও একটা কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ভালো কবিতা কখনো পুরোনো হয় না, বারবার পড়া যায়, ৭ মার্চের ভাষণও পুরোনো হয় না, হবে না। বলে।

দৈনিক বিবিয়ানা: স্যার ভাষণের ঐতিহাসিক দিকটি কী?

সৈয়দ আব্দুল্লাহ: ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু সেই ইতিহাসটা অপরূপ কাব্যসুষমান্বিত ভাষায় অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করেন, ‘২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস।’ এরপর তিনি স্টোরিটেলার বা গল্পের কথকের মতো করে বর্ণনা করে গেলেন ওই সময়ের প্রেক্ষাপট। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে কোনভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১লা মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শুরু হলো দুর্বার আন্দোলন। ’৭১ সালের ২ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালিত হলো। সেদিনই, এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ৩ থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হরতাল পালিত হলো। ৩ মার্চ পালন করা হলো শোক দিবস। সেই সঙ্গে ঘোষণা করা হলো, ৭ মার্চ দুপুর ২টায় ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল গণসমাবেশ আয়োজিত হবে; সেখানে ভাষণ দেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হ্যাঁ, এই ভাষণটিকেই বলা হয় ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।

দৈনিক বিবিয়ানা: ইউনেসকো এটাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

সৈয়দ আব্দুল্লাহ: শেখ সাহেবের জীবনকাহিনির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়ে রইল ৭ মার্চের ভাষণ। ইউনেসকো এটাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে সঠিক কাজটাই করেছে। এই ভাষণ সব দেশের সব নিপীড়িত মানুষকেই প্রেরণা জুগিয়ে যাবে চিরকাল। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে গেল? এটা শুধু বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি নয়, দেশের জন্যও এক বড় স্বীকৃতি? এখন এটাকে আরো ছড়িয়ে দিতে হবে? বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না, তিনি বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের নেতা ছিলেন? ২০১৫ সালে ক্যানাডার একজন অধ্যাপক সারা বিশ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে একটা গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন? সেখানেও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল? তখন অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি পেলেও এবার পেলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি? এর বহু আগেই ব্রিটিশ ইতিহাসবিদJacob F Field, We Shall Fight on The Beaches : The Speeches That Inspired History শিরোনামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন, যা ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে অন্যান্যের মধ্যে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (মেসিডোনিয়া, প্রাচীন গ্রিস), জুলিয়াস সিজার (রোম), অলিভার ক্রমওয়েল (ইংল্যান্ড), জর্জ ওয়াশিংটন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (ফ্রান্স), যোসেফ গ্যারিবোল্ডি (ইতালি), আব্রাহাম লিংকন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ভ্লাদিমির লেনিন (রাশিয়া), উইড্রো উইলসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), উইনস্টন চার্চিল (যুক্তরাজ্য), ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), চার্লস দ্য গল (ফ্রান্স), মাও সেতুং (গণচীন), হো চি মিন (ভিয়েতনাম) প্রমুখ নেতাদের বিখ্যাত ভাষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাই এই ভাষণটি নতুন করে বিশ্বের নিপড়িত মানুষের প্রেরণা হিসাবে কাজ করবে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করায়। যা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।

দৈনিক বিবিয়ানা: স্যার আমরা জানি ৭মার্চ ভাষণটি আপনি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে শুনেছিলেন। সে সম্পর্কে জানতে চাই?

সৈয়দ আব্দুল্লাহ: আমি এই ভাষণ শুনার জন্য দুদিনন আগেই ঢাকাতে হাজির হয়েছিলাম কজন বন্ধুসহ। দিনটি ছিল রোববার। সকালে আমরা রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয় লক্ষ লক্ষ জনতার সাথে। পুরো ময়দান সকাল থেকেই পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। জনসভায় যোগদানের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ লাখ মানুষ জলোচ্ছ্বাসের গর্জনে বাস, লঞ্চ, স্টিমার, নৌকা ও হেঁটে বিপুলবিক্রমে রাজধানী ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। বাঁধভাঙা মানুষের গ্রোতে দুপুরের আগেই ভরে যায় পুরো রেসকোর্স ময়দান। ১০ লাখেরও অধিক মানুষ জড়ো হয়েছিল সেদিন বঙ্গবন্ধুর অভূতপূর্ব বাণী শোনার জন্য। বাতাসে উড়ছিল বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল সূর্যের পতাকা আর সঙ্গে সঙ্গে দুলে উঠছে বাঙালিদের সংগ্রামের প্রতীক লাখ লাখ বাঁশের লাঠি। সেই সঙ্গে ‘আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, পরিষদ না রাজপথ-রাজপথ রাজপথ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর-বাংলদেশ স্বাধীন কর’, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ইত্যাদি মুহুর্মুহু সস্নোগানে মুখরিত হয়েছিল পুরো এলাকা। সভা শুরুর আগে কুরআন তেলাওয়াত করেছিলেন, মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদি আর ভাষনের পর মুনাজাত করেছিলেন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ।

দৈনিক বিবিয়ানা: বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চ ভাষণের তাৎপর্য দিক কোনটি? কেন এটি মানুষের হৃদয়ে এতো নাড়া দিয়েছিল?

সৈয়দ আব্দুল্লাহ: ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মূলত একটি জাতীর মুক্তিসংগ্রামের লক্ষে জাতির জনকের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে একটি পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা ছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরিপূর্ণতার দিকটি বুঝতে হল এই অংশটুকো দেখ, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের এক জায়গায় বলছেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে!”। বঙ্গবন্ধুর এই যে দিকনির্দেশনা বাঙালি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ১৯৭১-এ বাঙালি দা-বল্লম-লাঠি-তীর-ধনুক এমনকি ইট-পাথর নিয়ে সুসজ্জিত পাকিস্তানী বাহিনির সাথে মোকাবেলা করার জন্যে বেরিয়ে এসেছে পথে। বাঙালির সেদিনের উন্মাদনার চিত্র লিখে বোঝানো অসম্ভব। এক কথায় বলতে পারি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যেন আক্ষরিক অর্থেই বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর মাথায় উঠে এসেছিলো। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততদিন খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো কেউ দেবে না। শুনুন মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনি ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায়- হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অ-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিও আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনা-পত্র নিতে পারে। পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সাথে দেয়া-নেয়া চলবে না।” যে কেউ সামান্য মনোযোগ দিলেই বুঝবেন ভাষণের এ অংশে কতটা দূরদর্শিতা বিদ্যমান। অন্যত্র তিনি বলছেন, “এবারের আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!” এই যে ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘মুক্তি’ অর্জনের কথা তিনি পৃথকভাবে উচ্চারণ করলেন, তার মধ্যেও কী গভীর দর্শন কাজ করেছে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। লক্ষ করলেই দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু ‘মুক্তি’ বলতে মানুষের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথাই বলেছেন; যা তাঁর ভাষণের প্রথম দিকেই তিনি উচ্চারণ করেছেন। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ কোন লিখিত ভাষণ নয়। তাৎক্ষণিকভাবে তার মাথায় বা চিন্তায় যা এসেছে, তাই তিনি উচ্চারণ করেছেন স্বতঃস্ফুর্ত ব্যাঞ্জণায়। ১৮ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যত কথা বলেছেন সবই তাঁর সম্যক উপলব্ধির কথা,জীবনাভিজ্ঞতার সাহসী উচ্চারণ; তাঁর এ ভাষণ তাঁর দেশপ্রেমেরও উদাহরণ। বঙ্গবন্ধুর সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। একটা হলো- বিচ্ছিন্নবাদী হওয়া আর অন্যটা স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়া। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে দুই কূলই বজায় রেখেছিলেন। ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেনি, এটি জাতিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতও করে। এটাই মূলত ৭মার্চ ভাষণের ঐতিহাসিক তাৎপর্য দিক।

দৈনিক বিবিয়ানা: ৭মার্চ ভাষণে কেন বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষনা দিলেন না?

সৈয়দ আব্দুল্লাহ: ঐতিহাসিক সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে স্বাধীনতার সংগ্রামের যে ডাক দিয়েছিলেন, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাণ বাজি রেখে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পরবর্তিতে বাংলার সাধারণ কিন্তু ভীষণ সাহসী সন্তানরা। তার নির্দেশে পাল্টে গিয়েছিল পুরো দেশের চিত্র। বিদ্রোহ-সংগ্রামের তরঙ্গ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছিল। তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষনা না করলেও মানুষের কাছে এটিই ছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। এটিই আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত আমাদের স্বধীনতার মূল দলিল হিসাবে বিবেচ্য।ঐতিহাসিক সেই ভাষণের কারণেই নিউজউইক সাময়িকীর একাত্তরের ৫ এপ্রিল সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ হিসেবে অ্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল। কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ‘৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধুই ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ আসলে স্বাধীনতার মূল দলিল।’ মার্শাল টিটো বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনোরকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ।’ ওয়াশিংটন পোস্ট এ বলা হয়, ‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরেবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’ আর এএফপিতে বলা হয়েছে, ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ঐদিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মিডিয়া এভাবেই ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

দৈনিক বিবিয়ানা: বঙ্গবন্ধু সরাসরি ৭মার্চ কেন স্বাধীনতার ঘোষনা দিলেন না?

সৈয়দ আব্দুল্লাহ: বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেন- আবার যুদ্ধে কিভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও বক্তব্য রাখেন। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ মার্চের জনসভার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের (বাঙালি) হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। প্রয়োজন হলে ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না।” এমন এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্সে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ সরকারপ্রধানের মতো এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।” প্রকৃতপক্ষে ’৭১-এর পহেলা মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের শাসন কায়েম হয়। যে জন্য তিনি বলতে পেরেছেন, ২৮ তারিখ কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। তিনি পাকিস্তানি শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হতে পারে। যে জন্য তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ করে দেবে।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও শত্রু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকে- ৭ মার্চের ভাষণে তাই তিনি বলেছেন। তা ছাড়া ভাতে মারবো, পানিতে মারবো- এ কথার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পর্যুদস্ত করার কথাই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে সময় এমন ছিল যে, কোনো কোনো বিদেশি পত্রিকাও তখন জানিয়েছিল- ৭ মার্চ শেখ মুজিব হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। ’৭১-এর ৫ মার্চ লন্ডনের গার্ডিয়ান, সানডে টাইমস, দি অবজারভার এবং ৬ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৭ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাভাস দেয়া হয়। ৬ মার্চ ’৭১ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হয়“শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন।” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ’৭১-এর ৭ মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২ এর ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির জন্য দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ওই ঘটনা বর্ণনা করেন। ফ্রস্ট শেখ মুজিবের কাছে জানতে চান, ‘আপনার কি ইচ্ছা ছিল যে, তখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন?’ জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।’ ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটত?’ শেখ মুজিব উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।’ ইতিহাস প্রমাণ করে- ৭ মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে বঙ্গবন্ধু শতভাগ সঠিক কাজটিই করেছেন। আবার পরোক্ষভাবে স্বাধীনতারও ঘোষনা দিয়েছেন” রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, বাংলার মাটিকে মুক্ত করেই ছাড়ব ইনশাল্লাহ।

SUMMARY

2203-1.jpg