সৈয়দ মোঃ আরিফ হোসেন
বাঙালি জাতিসত্তা সৃষ্টির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় একটি দিন ৭ই মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে এক তাৎপর্যপূর্ণ মহাকাব্যের সৃষ্টি করেন। এই মহাকাব্যই ইতিহাসে ‘৭ই মার্চের ভাষণ’ হিসেবে পরিচিত, যা পরবর্তীতে দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণের স্বীকৃতি পেয়েছে।
সারাবিশ্বের প্রথিতযশা ঐতিহাসিকগণ বিস্তর পরিসরে গবেষণা করে ‘৭ই মার্চের ভাষণ’কে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইতিমধ্যেই ইউনেস্কো ‘ডকুমেন্টরি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য দলিল) হিসেবে ৭ই মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ এ সংগৃহীত করেছে। অথচ এক সময় স্বাধীন বাংলাদেশে এই ভাষণ প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ভাষণের ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি পাওয়াকে ইতিহাসের প্রতিশোধ হিসেবে তুলনা করেছেন। কোন কোন ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই আমরা বলি, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেস্কোই সম্মানিত হয়েছে।
মাত্র ১৮ মিনিটের হলেও, ৭ই মার্চের ভাষণই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন একবার কোন এক সেমিনারে বলেছিলেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ শ্রেষ্ঠ ভাষণ’। সত্যিই এটা কল্পনাতীত, মাত্র ১৮ মিনিটের ছোট্ট একটা ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন স্বাধিকারের দৃঢ় প্রত্যয়ে। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের জাদু। তাঁর নির্দেশে বিনাবাক্যে সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ২রা মে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল, যেখানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গ্রহনযোগ্যতা সম্পর্কে বহির্বিশ্বে তুলে ধরা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনের অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো-‘মার্চে শাসনতান্ত্রিক এই সংকট যখন সৃষ্টি হয়, তখন শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সাধারণ বাঙালির কাছে তাঁর কাপড় স্পর্শ করা ছিল তাবিজে শুভ ফল পাওয়ার মতো। তাঁর বাক্যই হয়ে উঠেছিল আইন। ধানমন্ডিতে তাঁর বাসা থেকে তিনি সব করেছিলেন, সবার সঙ্গেই ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তাঁর কাছে যাওয়ার কোন বাঁধা ছিল না, প্রতিদিন দেখা করতেন অজস্র লোকের সাথে। সম্পদ বা পদমর্যাদার দিকে তাঁর কোন নজর ছিল না, সম্পূর্ণভাবে আন্তরিক ছিলেন জনগনের প্রতি। প্রতিটি বাঙালি, তিনি যত তুচ্ছ বা গরিবই হোন না কেন, তিনি তাকে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান দিয়েই বিবেচনা করতেন, সাহায্য করতেন। তার নাম, তার পরিবারের অবস্থা কখনও ভুলতেন না, প্রতিদানে বাঙালিরা তাঁকে বিশ্বাস করতেন, তাঁর সততা, আত্মত্যাগ, সাহস ও তাদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার বিষয়টিও বিশ্বাস করতেন।’ (তথ্যসূত্রঃ এ কে এম আব্দুল মোমেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’, ১৯৭১ এর স্মৃতিচারণ)। সুতরাং নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের এই সূত্র ধরেই বোঝা যায়, সমগ্র বাঙালি জাতির উপর বঙ্গবন্ধুর কতোটা প্রভাব ছিল।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা। তিনি জানতেন, ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুর জনসভায় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই ভাষণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তিনি সুকৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, যে কারনে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বিচার করার সুযোগ পেলো না। ভেস্তে গেলো পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি নিধনের গোপন প্রস্তুতি। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোয়ন্দা প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে 'চতুর' হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা লিখেন-‘শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলো কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’ এর পর দিন অর্থাৎ ৮ই মার্চ সংবাদ মাধ্যমগুলির লিড লিউজ ছিল এরকম যে, ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন’।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ঐতিহাসিকগণ প্রতিনিয়ত ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে গবেষণা করছেন। এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত যে, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ভাষণগুলোর প্রায় সবগুলোই ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অলিখিত। বঙ্গবন্ধু নিজেও জানতেন না যে, তিনি কি বলবেন বা কিভাবে শুরু করবেন। পরক্ষনে স্টেজে উঠে যখন বক্তৃতা শুরু করলেন, মনে হলো তিনি যেন বাঙালি জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যটি রচনা করছিলেন। তাই ৭ই মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর অমর রচনা, বাঙালির শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য, যেটি বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার লালিত স্বপ্ন থেকে রচিত। যুগে যুগে সকল সমাজের নিপীড়িত, নির্যাতিত এবং স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষকে উৎসাহ, উদ্দীপনা আর অনুপ্রেরণা যোগাবে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ।