এইচ আর তুহিন :
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ একটি জাতি-জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী সৃষ্টি, এক মহাকাব্য। বহুমাত্রিকতায় তা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্ব মানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল বা সম্পদ। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে এটিই স্বীকৃত। ১৯৯২ সাল থেকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছে।
২০১৭ সালে ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিসে অনুষ্ঠিত এর দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্ত করে। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা/ বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক দুবছর ধরে প্রামাণ্য দালিলিক যাচাই-বাছাই শেষে ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনারেলের সম্মতিক্রমে এটি সংস্থার নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পরে হলেও জাতিসংঘের মতো বিশ্বসংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর ফলে বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রণোদনাময়ী ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বব্যাপী মানবজাতির মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত হলো। স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গকৃত ৩০ লাখ শহিদ আর সম্ভ্রম হারানো কয়েক লাখ মা-বোনসহ আমাদের সবার জন্য এটি এক মহাআনন্দ ও বিরল সম্মানের ঘটনা।
এর আগে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা শহিদ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে এখন সারাবিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর নিজ ভাষার অধিকার সংরক্ষণের প্রতীক হিসেবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই ভাষা-আন্দোলনে শুধু সংগঠকের ভূমিকাই পালন করেননি, তিনি ছিলেন ভাষা-আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দিদের অন্যতম।
গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিসের অপর এক নগররাষ্ট্র স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত স্বদেশীয় সৈন্য ও সাধারণ মানুষের স্মরণে প্রদত্ত ভাষণ (৪৩১ খ্রি.পূর্ব) থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের ১৯৮৭ সালে বার্লিনে দুই জার্মানির মধ্যকার বিভক্তির দেয়াল (বার্লিন ওয়াল) ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার আহ্বান সংবলিত ভাষণ পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক-বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F Field, We Shall Fight on The Beaches : The Speeches That Inspired History শিরোনামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন, যা ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে অন্যান্যের মধ্যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (মেসিডোনিয়া, প্রাচীন গ্রিস), জুলিয়াস সিজার (রোম), অলিভার ক্রমওয়েল (ইংল্যান্ড), জর্জ ওয়াশিংটন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (ফ্রান্স), যোসেফ গ্যারিবোল্ডি (ইতালি), আব্রাহাম লিংকন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ভ্লামিদিন লেনিন (রাশিয়া), উইড্রো উইলসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), উইনস্টন চার্চিল (যুক্তরাজ্য), ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), চার্লস দ্য গল (ফ্রান্স), মাও সে তুং (গণচীন), হো চি মিন (ভিয়েতনাম) প্রমুখ নেতাদের বিখ্যাত ভাষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি কেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণগুলোর অন্যতম হিসেবে অভিহিত তার উত্তরে সংক্ষেপে যা বলা যায় যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণ মাত্রই তা প্রচ- উদ্দীপনীয়। যা মুহূর্তে মানুষকে নব চেতনায় জাগিয়ে তুলে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে তাদের প্রস্তুত করতে পারঙ্গম। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে নজিরবিহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো, আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।’ ঠিকই, কোনোরূপ আপোশকামিতার পথে না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ৫-১০ লাখ নয়, ৩০ লাখ লোক আত্মোৎসর্গ করে এবং কয়েক লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারান, যা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন।
শ্রেষ্ঠ ভাষণের আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দেশাত্মবোধ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের মূল ও আশু লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা তাই বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শ্রেষ্ঠ ভাষণের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সময়ের পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে তা হয় কালোত্তীর্ণ ও সব সময়ের জন্য প্রেরণাদায়ী তাই তিনি বলেছিলেন ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’।
ইতিহাসখ্যাত শ্রেষ্ঠ ভাষণের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এর কাব্যিকতা, শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাস। যা হয়ে ওঠে গীতিময় ও শ্রবণে চতুর্দিকে মধুর। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি ঠিক অনুরূপ। যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণই বিদ্যমান পরিস্থিতি উত্থিত, একই কারণে তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় উৎসারিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণও ছিল তাই। কোনোরূপে লিখিত ছিল না। অথচ পৃথিবীর অন্য অনেক শ্রেষ্ঠ ভাষণ লিখিত ছিল।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এক অনন্য-অসাধারণ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত এবং মানবজাতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে গৃহীত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে জাতিসংঘের বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে (১০ই ডিসেম্বর ১৯৪৮) ঔপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, জাতি-নিপীড়ন ইত্যাদি থেকে পৃথিবীর সর্বত্র জাতি-জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি গৃহীত ও স্বীকৃত হয়। পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও জাতি-নিপীড়নের নিগড় থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে নির্দেশিত বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ছিল ওই নীতি-আদর্শের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।