বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দিন ৭ই মার্চ। ১৯৭১ সালের এদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ডাক দেন- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, ঘরে ঘরে দূর্গো গড়ে তোলো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ...। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’
লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ সময়ের পরিক্রমায় তা আজ বিশ্বের মানুষের কাছে সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। এই ভাষণে রয়েছে বহুমূখী বৈশিষ্ট্য-
প্রথমত: বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল নির্যাতিত একটি জাতির করণীয় ও নির্দেশনামূলক ভাষণ, যার মাধ্যমে একটি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উজ্জীবিত হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত: ভাষণের একটি উল্লেখ্যযোগ্য দিক হচ্ছে এর কাব্যিকতা; শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে তা হয়ে উঠেছে গীতিময় ও শ্রবণে চতুর্দিকে অণুরণিত। তাই বিশ্বখ্যাত নিউজউইক ম্যাগাজিন ৭ই মার্চের ভাষণের জন্যই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
তৃতীয়ত: এক হাজার ১০৫টি শব্দের সমন্বয়ে ও মাত্র ১৮ মিনিট, মতান্তরে ১৯ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণটি ছিল সম্পূর্ণ অলিখিত।
চতুর্থত: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়।
পঞ্চমত: বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সে ভাষণটি পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম ভাষণ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলে জায়গা করে নিয়েছে।
ষষ্ঠত: আড়াই হাজার বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক-বেসামরিক জাতীয় বীরের ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব ফিল্ড ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে ‘We Shall Fight on The Beaches: The Speeches That Inspired History’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন।
যেখানে আলেকজেন্ডার দ্য গ্রেট (মেসডোনিয়া, প্রচীন গ্রিস), জুলিয়াস সিজার (রোম), অলিভার ক্রম ওয়েল (ইংল্যান্ড), জর্জ ওয়াশিংটন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ভ্লাদিমির লেনিন (রাশিয়া), মাও সেতুং (গণচীন) প্রমুখ নেতাদের বিখ্যাত ভাষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সপ্তমত: ২০১৫ সালে কানাডার একজন অধ্যাপক সারা বিশ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে একটা গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণও ছিল।
অষ্টমত: সর্বশেষ ইতিহাসের পাতায় ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টরি হেরিটেজ) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। ফলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি এখন শুধু বাঙালি জাতিরই নয় বরং বিশ্ব মানবতার সম্পদ।
নবমত: বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল কালোত্তীর্ণ। এ ভাষণ কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, এটি সর্বকালের ও সব সময়ের। কেননা, যুগে যুগে এই ভাষণ পৃথিবীর যেকোনো স্থানের স্বাধীনতাকামীদের প্রেরণাদায়ী।
দশমত: বলা হয়, সারা বিশ্বে সর্বাধিকবার প্রচারিত ও শ্রবণকৃত ভাষণ হলো- ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণ।