৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয় দিয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, রণকৌশলের দিক থেকেও এই ভাষণ অসাধারণ। এই বক্তৃতা এখনো মানুষকে শিহরিত করে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ। বলা যায়, বিশ্বের ১০টি ভাষণের অন্যতম। কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণটি বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের জ্ঞানদীপ্ত প্রজ্ঞার ফসল। মাত্র ১৮ মিনিটের এই ভাষণ ছিলো বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে অমোঘ নির্দেশনা এবং জেগে ওঠার মন্ত্র। মহাকাব্যিক এই ভাষণে একটি কথাও কম ছিলো না, বেশি ছিলো না। সেদিনের উত্তাল জনতরঙ্গে সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় যা অনিবার্য তা-ই বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল।
অবৈজ্ঞানিক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই যখন আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির ওপর হামলা হয় সেদিন বঙ্গবন্ধু প্রথম উপলব্ধি করেছেন এই রাষ্ট্র কাঠামো জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক। তাই এই রাষ্ট্রে বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়। প্রয়োজন বাঙালির স্বাধীন আবাস ভূমি। এই লক্ষ্যপূরণে লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলনের ধাপ অতিক্রম করে মুক্তিসনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। তিনি এও জানতেন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ৬ দফা মেনে নেবে না। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে ৬ দফা একদফায় পরিণত হয়। তাই বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে শেষ বাক্য ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতিপর্ব। ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণটিকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় এটা আজ সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে অমূল্য রতন ও জেগে ওঠার মন্ত্র। তাই আজ আমরা গর্বিত।
এই ভাষণের মধ্যে বাঙালি জাতিকে কখন কী করতে হবে, তা স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে বঙ্গবন্ধু নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল-প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছুু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি আর্মিদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়ে বলেন, ‘আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’ এই ভাষণের মধ্য দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি একটি সশস্ত্র জাতিতে পরিণত হয় এবং বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনে অভিষ্ঠ লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যায়। এই ভাষণ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন গবেষণা হচ্ছে। পাকিস্তানিরা আমাদের অধিকার, সম্মান ও ঐতিহ্যকে দিন দিন ভুলুণ্ঠিত করে যাচ্ছিল। তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতার সবুজ সংকেত। এই একটি মাত্র ভাষণেই আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি খুঁজে পেয়েছিলাম।
এই ভাষণের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সময়ের পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে তা হয়ে উঠেছে কালোত্তীর্ণ ও প্রেরণাদায়ী। ইতিহাসখ্যাত এই ভাষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এর কাব্যিক গুণ-শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে যা হয়ে ওঠে গীতিময় ও শ্রবণে চতুর্দিকে অনুরণিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি অনন্যসাধারণ, যে কারণে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত হন পয়েট অব পলিটিক্স। যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণই উত্থিত হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে, ফলে তাকে তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় উৎসারিত বলা যায়। শ্রেষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত ইতিহাসখ্যাত ভাষণের অপর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আকারে নাতিদীর্ঘ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ যুগে যুগে বাঙালি জাতিকে শক্তি ও সাহস যোগাবে। আমাদের মহান নেতার এই ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরন্তন ও সর্বজনীন হয়ে থাকবে।