।। ডা. জাহিদুর রহমান ।।
২০১৭ সালের গত ৩০ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা কমিটি দুই বছর ধরে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করার পর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার-২০১৭’-এ অন্তর্ভুক্ত করে। দেরিতে হলেও ইউনেস্কোর এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এখন আর শুধু বাঙালির কাছে নয়। এই ভাষণ পুরো পৃথিবীর কাছেই একটি মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়েছে।
ইউনেস্কোর ‘দ্য মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ প্রকল্পটি ১৯৯২ সালে চালু হয়। তখন থেকে ইউনেস্কো এই প্রকল্পের মাধ্যমেই বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তা সংরক্ষণও করে আসছে। পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন দেশেরই নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। গর্বিত ইতিহাস আছে। কিন্তু যুদ্ধ-বিগ্রহ, সম্পদের অপ্রতুলতা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বৈশ্বিক সম্পদগুলো প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডের’ মুল লক্ষ্য এসব সম্পদেকে স্বীকৃতি দেওয়া ও সংরক্ষণ করা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এখন থেকে তাদের ডিজিটাল তথ্য ভাণ্ডারে অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত থাকবে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে এই ভাষণটি ডাউনলোডও করা যাবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক দলিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত ঐতিহ্যের সংখ্যা এখন ৪২৭-তে উন্নিত হলো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি এর আগেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন ব্যক্তির বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের ‘We Shall Fight on The Beaches : The Speeches That Inspired History’ বইটিতে জায়গা করে নেয় এই ভাষণ। বইটির বেশিরভাগ ভাষণই ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও লিখিত। যেমন ১৮৬৩ সালের আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’, নামে ২৭২ শব্দের দুই মিনিটের লিখিত ভাষণটি ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের সামনে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ অ্য ড্রিম’, নামের ১৬৬৬ শব্দের ১৭ মিনিটের লিখিত ভাষণটি প্রায় দুই লাখ মানুষের সামনে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪০ সালের উইনস্টন চার্চিলের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস’, নামে পরিচিত ৩৭৬৮ শব্দের ১২ মিনিটের ভাষণটি ৬০০ মানুষের সামনে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের জওহরলাল নেহেরুর ‘অ্যা ট্রাইস্ট উইথ ডেস্টিনি’, নামে পরিচিত ৭৫৫ শব্দের পাঁচ মিনিটের ভাষণটি ৫০০ মানুষের সামনে দেওয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল অলিখিত এবং কোনো ধরনের পূর্ব প্রস্তুতিবিহীন। সামনে ছিল ১০ লাখ স্বাধীনতার স্বাদ পেতে মরিয়া ১০ লাখ বাঙালি। ১০৯৫টি বজ্রকঠিন শব্দে তৈরি ১৮ মিনিটের ভাষণটি ছিল সত্যিকার অর্থেই বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত এই ভাষণটি প্রচণ্ড মাত্রায় উদ্দীপনার ও প্রেরণাদায়ী। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। … রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।’ ৭ মার্চের ভাষণে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দেশাত্মবোধ ছিল, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির এবং অর্জনে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের মূল ও আশু লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ভাষণের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সময়ের পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে তা হয় কালোত্তীর্ণ ও সব সময়ের জন্য প্রেরণাদায়ী।
যুদ্ধের ভয়াবহতায় কিংবা সংরক্ষণের অভাবে পৃথিবীর বুক থেকে মূল্যবান অগণিত সম্পদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বেলজিয়ামের লভেঞ্জ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ৩ লাখ বই পুড়িয়ে দেয়। যুদ্ধের পর অবশ্য বিভিন্ন দেশের সহায়তায় লাইব্রেরিটিকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিধি বাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেই একই জার্মান সৈন্যদের হাতেই লাইব্রেরিটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ধারণকৃত অডিও ও ভিডিও ফুটেজের ওপরেও আক্রমণ কম আসেনি। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তিরা বারবার চেষ্টা করেছে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মূলমন্ত্র, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ধ্বংস করতে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের তৎকালীন কর্মীদের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। তারা শুধু ৭ মার্চের ভাষণটি ধারণই করেননি, জীবন বাজি রেখে সেটি সংরক্ষণও করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে ভাষণটি রক্ষা করতে চলচ্চিত্র বিভাগের তদানীন্তন পরিচালক মহিবুর রহমান খাঁ (আমাদের সবার প্রিয় অভিনেতা আবুল খায়ের) চলচ্চিত্র বিভাগের তদানীন্তন সহকারী চিত্রগ্রাহক আমজাদ আলী খন্দকারের মাধ্যমে ভাষণের কপি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলেন। ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল ৭ই মার্চের ভাষণের ফুটেজ একটি ট্রাংকে ভরে বেবিট্যাক্সিতে করে সোয়ারি ঘাটে নেওয়া হয়। সচিবালয় থেকে সোয়ারি ঘাট পর্যন্ত পুরোটা রাস্তাজুড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছিল। এর মধ্যেই আমজাদ আলী খন্দকার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৭ মার্চের ভাষণটি নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে এগিয়ে যান। বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে তিনি জিঞ্জিরা হয়ে মুন্সীগঞ্জের জয়পাড়া মজিদ দারোগার বাড়িতে চলে যান।
মহিবুর রহমান খাঁ নিজেও আমজাদ আলীর পেছনে পেছনে গন্তব্যে পৌঁছে যান। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ৭ই মার্চের ভাষণের রিল পুনরায় চলচ্চিত্র বিভাগের স্টোরে নিয়ে আসা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরও ৭ মার্চের ভাষণের রিলটি নষ্ট করার জন্য হত্যাকারীরা লক্ষ্যে চলচ্চিত্র বিভাগে হামলা চালায়। কিন্তু এই বিভাগের কিছু অসীম সাহসী কর্মীদের বুদ্ধিমত্তায় বেঁচে যায় ৭ মার্চের ভাষণ। তারা ভাষণটির মূল সাউন্ড ও পিকচার নেগেটিভ ভিন্ন নামের একটি ফুটেজের ক্যানে লুকিয়ে রাখেন।
বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বেশি আলোচনা হলেও ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণটি নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না। অথচ এই দুটো ভাষণ পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু নেতা হিসেবে কতটা দূরদর্শী ছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণ যদি আমাদের স্বাধীনতা দিবসের ভুমিকা হয়, তাহলে আমাদের বিজয় দিবসের উপসংহার নিঃসন্দেহে ১০ জানুয়ারির ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষণের মতো এটিও ছিল সম্পূর্ণভাবে অলিখিত, পূর্বপ্রস্তুতি বিহীন। ৭ মার্চের ভাষণে ছিল স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার আহ্বান আর ১০ জানুয়ারির ভাষণে ছিল দেশ গড়ার নির্দেশনা। আমরা চাই, ৭ মার্চের ভাষণের মতো ১০ জানুয়ারির ভাষণটি সংরক্ষণেও সরকার যথেষ্ট আন্তরিক হবে। জাতি হিসেবে আমরা যে চরম অকৃতজ্ঞ তার প্রমাণ হয় বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে স্বাধীনতা অর্জনের মাথায় সপরিবারে হত্যা করা। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর এদেশে বঙ্গবন্ধু এক ধরনের নিষিদ্ধ ছিলেন। রেডিও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা যেতো না, শোক দিবস পালন করা হতো না, এমনকি স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে তাকে মেনে নিতেও আমাদের দ্বিধা ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে ইতিহাসের পাতা থেকে আবার সসম্মানে বঙ্গবন্ধুকে তুলে আনার চেষ্টা চলছে। সেরকম একটি প্রচেষ্টারই ফসল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি দেওয়া।
বাঙালি ৩০ লাখ জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে ১৯৭১ সালেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কার্যকারিতা প্রমাণ করে দিয়েছে। তাই ইউনেস্কো এতদিন পর এই স্বীকৃতি দিয়ে যত না আমাদের সম্মানিত করেছে, তারচেও বেশি সমৃদ্ধ করেছে নিজেদের তথ্য ভাণ্ডার। এখন থেকে সারা পৃথিবীর আরও অনেক মানুষ বাঙালি জাতির জনককে নিয়ে গবেষণার সুযোগ পাবে। দেশবাসীর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়াই হোক এবারের স্বাধীনতা দিবসের মূল লক্ষ্য।
লেখক: চিকিৎসক