যে মাওলানাকে পিতাতুল্য মনে করতেন বঙ্গবন্ধু


সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ

এই একজন মাওলানা। যাকে বঙ্গবন্ধু পিতাতুল্য মনে করতেন। রাষ্টপতি হওয়ার পরেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে তিনি গুরুর মতো, পিতার মতো, উস্তাদের মতো পরম শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। এই মাওলানাই বঙ্গবন্ধুকে নিজের সাথে রেখে রাজনীতি শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন প্রেম দ্রোহ আর সংগ্রাম।

তাই বঙ্গবন্ধুর জীবনী লিখতে গেলে এই মাওলানার কথা লিখতেই হয়। নতুবা বঙ্গবন্ধু চর্চা অপূর্ণ থেকে যায়। কারণ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আর শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালি চেতনার এক অভিন্ন নাম। এই দুজন নেতা আমাদের চেতনার দুটি স্রোতধারার মিলিত একটি মোহনা।

ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা ইতিহাস থেকে সব লিখলে বিশাল একটি গ্রন্থ রচিত হবে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয।

এরপর ভাসানী ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬পর্যন্ত ৮ বছর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন । টাঙ্গাইলের মোহাম্মদ শামছুল হক ছিলেন সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন সহ সাধারণ সম্পাদক পরে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

একদিনের ঘটনা, মাওলানা ভাসানী তখন দলের সভাপতি আর বঙ্গবন্ধু দলের সাধারণ সম্পাদক। একদিন মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে আট আনা পয়সা দিয়ে নারায়নগঞ্জে একটি কাজে পাঠান। বঙ্গবন্ধু নারায়নগঞ্জ থেকে সারিদিনে সে কাজ সম্পন্ন করে এসে বিকেলে মাওলানা ভাসানীর হাতে আট আনা পয়সা ফেরত দেন।

মাওলানা ভাসানী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, মুজিব তুমি নারায়ণগঞ্জ কিভাবে গেলে..? উত্তরে মুজিব বলেন ‘সাইকেল নিয়ে গিয়েছিলাম, টাকাটা বেঁচে গেছে’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মওলানা পুত্রসম স্নেহ করতেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার রাজনৈতিক জীবনে অনেক সেক্রেটারি এসেছে কিন্তু মুজিবরের মতো যোগ্য সেক্রেটারি অন্য কাউকে পাইনি।’

উল্লেখ্য মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালে বঙ্গবন্ধু তার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুও মওলানাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রায়ই কোনো নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়াই শুধুমাত্র গাড়ির ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মওলানার সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতেন।

সে খবর তৎকালীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই জানতেন না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তখন মওলানা ভাসানী খুবই কেঁদেছেন। তিনি ওইদিন বার বার বলেছেন, ‘সব শেষ হয়ে গেল’। তিনি এতো দু:খ পেয়েছিলেন যে, ঐদিন কোনো কিছুই খাননি, কারো সাথে সাক্ষাৎও করেননি।

খোন্দকার মোশতাক আহমেদের পক্ষ থেকে তার কাছে দূত পাঠানো হয়েছিল তার সরকারকে সমর্থন করে একটি স্টেটমেন্ট দেয়ার জন্য, কিন্তু মওলানা তার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন। বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদ মওলানাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করতেন কিন্তু মওলানা সবার চালাকি বুঝতে পারতেন।

কিছু স্মৃতি, কিছু কথা, শহিদুল ইসলাম, হককথা, ৭ নভেম্বর ২০১৫

বঙ্গবন্ধু একান্ত সচিব মসিউর রহমান ১৫ আগস্ট, ২০১৫ দৈনিক কালের কন্ঠে লিখেছেন, ‘মওলানা ভাসানী ছিলেন সবার সম্মানিত জ্যেষ্ঠ নেতা। তাঁকে কখনো আসতে দেখিনি। মওলানা ভাসানীর অনুরোধ কখনো উপেক্ষা করা হতো না, নির্দেশ হিসেবে মেনে নেওয়া হতো বলা যায়। একবার বঙ্গবন্ধুকে তিনি চিঠি লিখলেন তাঁর ওষুধের দরকার। থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে চেষ্টা করে আমরা ব্যর্থ হই।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বঙ্গবন্ধু অনুরোধ জানালে তাঁরা ওষুধটি পাঠান। মওলানা ভাসানীকে সন্তোষে সেই ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হয়। আরেকবার মওলানা ভাসানী চিঠিতে জানালেন, টাঙ্গাইলের কয়েকজন লোককে যেন টিনের পারমিট দেওয়া হয়; টিন বেচে অথবা অন্যভাবে অর্জিত টাকা তারা সন্তোষ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে দান করবে। টিনের তখন আকড়া, কালোবাজারে দাম চড়া, মুনাফা অনেক।

বঙ্গবন্ধু চিঠিটি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী কামরুজ্জামানের সঙ্গে আলাপ করার নির্দেশ দেন। তিনি জেলে নিহত অন্যতম জাতীয় নেতা। বাণিজ্যমন্ত্রী দুপুরের পরে সময় দেন। তাঁকে চিঠিটা দেওয়ার পর তিনি বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়লেন, যে সময় দরকার তার চেয়ে বেশি সময় দিলেন চিঠি পড়তে। আমার মনে হয় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কী করা যায় তা-ও চিন্তা করছিলেন।চিঠি পড়া শেষ হলেকামরুজ্জামান আমার দিকে চোখ তুলে চাইলেন।

চা খেয়েছি কি না জিজ্ঞেস করলেন। তারপর চিঠিটি ভাঁজ করে পকেটে রেখে বললেন, এভাবে টিনের পারমিট দেওয়া ঠিক নয়; তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করবেন; অন্য কোনোভাবে মওলানা সাহেবের চাহিদা পূরণ করা হবে। নীতি ভাঙতে তাঁরা নারাজ। বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনবোধ করে নিজেই সন্তোষে যাওয়ার আয়োজন করলেন। বললেন, হুজুর না হয় কষ্ট পাবেন।

মন্ত্রী পরিষদের অনেক সদস্যসহ মাত্র একটি কথা বলার জন্যে দেশের রাষ্টপতি সন্তোষে ভাসানীর দরবারে রওনা হলেন। ‘ভাসানীর সহচর নাট্যকার গবেষক আশকরর ইবনে শাইখ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর বাকশালের সময় ভাসানী ক্ষুব্দ হয়েছিলেন। তার সম্পাদিত হককথা পত্রিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের সমালোচনা করেছেন কঠোরভাবে। কিন্তু তাদের উভয়ের মধ্যে সম্পর্কে কোন ছেদ পড়েনি।

১৯৭৪সালের ১৪ এপ্রিল ভাসানী পল্টনে হুকুমতে রব্বানী পাটির উদ্যোগে এক মহাসমাবেশের ডাক দেন। পরে একটি মিছিল নিয়ে রাষ্টপতির কার্যালয় ঘেরাওয়ের জন্য বঙ্গবভনের দিকে যাত্রা শুরু করেন। খবর শুনে রাষ্টপতি শেখ মুজিবুর রহমান রাস্তায় চলে আসেন। মিছিল কাছে আসতেই বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানীর পা ছুয়ে সালাম করলেন। এ দৃশ্য দেখে হাজার হাজার মিছিলকারী জনতা হতভম্ভ।

বঙ্গবন্ধু হুজুরসহ কয়েকজন নেতাকে সম্মান দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। হুজুরকে ধরে ধরে নিলেন। ভেতরে বসিয়ে মিষ্টিমুখ করালেন। তার সার্বিক পরিস্থিতি হুজুরের সামনে তুলে ধরলেন। হুজুর কিছু পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিলেন।’

বঙ্গবন্ধু যতোদিন জীবিত ছিলেন ভাসানীর নামে মাসিক ভ্রাতা পাঠাতেন। চিকিৎসা ও ঔষধপত্রের জন্য আলাদা খরচ দিতেন। নিয়মিত খোঁজ খবর নিতেন। ঈদ উৎসবে ভাসানী পরিবারের সদস্যদের জন্য জামা কাপড় জুতা ও খাবার পাঠাতেন। এই ছিল মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর প্রেমময় হৃদ্যতা।

দুজনের মধ্যে অনেক চিঠিপত্র ও ট্রেলিগ্রাম আদান প্রদান হয়েছে নিয়মিত। নিচে নমুনা সরূপ কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে লেখা ভাসানীর একটি চিঠি তুলে ধরা হল।

৩০ এপ্রিল, ১৯৫১, ১৮ নং কারকুন বাড়ি লেন ঢাকা, ৩০-৪-৫১

দোয়াবরেষু!
আমি সর্বদাই গ্রাম অঞ্চলে বাস করি কারণ গ্রামের মরণাপন্ন (চিঠিতে বানান মরণাপন্য) কৃষক-মজুরদের অবস্থা ভাল না হইলে এবং পাকিস্তান শুধু কয়েকজন বড় লোকের নহে। সাড়ে সাতকোটি লোকের পাকিস্তানের উন্নতি স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতি,অনাচার, অবিচারদমনের ব্যবস্থা আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করার দায়িত্ব সকলকেই গ্রহণ করিতে হইবে।

প্রাণের চেয়ে প্রিয় জিনিস পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিককে অনুভব করিতে হইবে। তোমার মুক্তির জন্য সরকারের দৃষ্টি বহুবার আকর্ষণ করিয়াছি কিন্তু ছেলে অন্ধ হইলে নাম পদ্মলোচন রাখলে লাভ কি। ধৈর্য্যধারণ করো আল্লাহ তোমার সঙ্গে আছেন। দেশের মুক্তির সঙ্গে তোমার মুক্তি। সরকার অস্থায়ী প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র স্থায়ী এবং আমাদের। আমার দোয়া জানিও এবং সকল বন্দীদিগকে জানাইও।

আবদুল হামিদ খান ভাসানী

SUMMARY

2178-1.jpg