পাকিস্তানি গোয়েন্দার চোখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান -শুভ কিবরিয়া

 
বাংলাদেশে ভক্তিবাদের প্রাবল্য সবসময় প্রকট ছিল। আজও তা সমানতালে বহমান। শক্তিমান বা ক্ষমতাবান মানুষের কাছে ভক্তিদান দুনিয়াবি সুবিধা দেয় বলে, আমজনতা ভক্তির স্রোতে গা ভাসাতে কার্পণ্য করে না। এটা মানুষের সহজাত প্রবণতা বলে উপেক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু শিক্ষিত সমাজ, বিবেকবান বলে পরিচিতি সুধীসমাজও এই সুবিধাবাদী ভক্তিবাদী জোয়ারে গা ভাসাতে ন্যূনতম লজ্জাও বোধ করে না। বিপদের দিনে এদের পাশে না পাওয়া গেলেও সুসময়ে এরা ক্ষমতাবলয়ের চারপাশে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে কার্পণ্য করে না। ফলে এখানকার সমাজনায়ক বা রাষ্ট্রনায়কের প্রকৃত জীবনকে জনসমাজের সামনে তুলে ধরাটা খুব সহজ হয় না। রাজনীতিবিদদের জন্য সেটা আরও কঠিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার এতবছর পরেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একটা অনুপ্রেরণাদায়ী, জীবননিষ্ঠ জীবনী আজও লেখা সম্ভব হয় নাই। এর কারণ সম্ভবত একদিকে বাংলাদেশের রাজনীতি নানা উলটপালট সম্পূর্ণ বিপরীত প্রবণতার রাষ্ট্রক্ষমতার আবহে পরিচালিত হয়েছে। যে যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে সে তখন তার মতো করে রাজনীতির ইতিহাস নির্মাণ করতে চেয়েছে। সেই প্রবণতা পাঠ্যপুস্তক থেকে গবেষকের মন সর্বত্র সমানভাবেই প্রভাব ফেলেছে।
 আবার একজন সত্যনিষ্ঠ গবেষক বা ইতিহাসঅনুসন্ধিৎসু চিন্তক মানুষের জন্য রাষ্ট্র কখনই তার হাতে থাকা গবেষণার উপাদান বা তথ্য সবার জন্য সহজলভ্য করেনি। তথ্যভা-ারের সহজপ্রাপ্যতার এই অভাব অনেক গবেষকের চিন্তাকেই আর অগ্রসর হবার সুযোগ দেয় নাই। বঙ্গবন্ধুর জীবন সম্পর্কে নানা তথ্যের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা বিরাজ থেকেছে। ফলে ভক্তিরসে আপ্লুত জীবনী ছাড়া একটা গবেষণালব্ধ, চিন্তাজাগানিয়া জীবনী রচিত হয় নাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও। একজন মানুষ কীভাবে একটা জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠলেন সেই পথচলার প্রতিটি মুহূর্তের সত্যনিষ্ঠ তথ্য সামনে না থাকলে চাইলেও তো একজন গবেষকের পক্ষে এই বিষয়ে গবেষণা করা সম্ভব নয়। আমাদের রাষ্ট্র সেই সুযোগ তৈরি করতে অতীতে ব্যর্থ হয়েছে।
আশার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উদ্যোগে ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য একটা সবিশেষ দুয়ার খুলে দিয়েছে। তার চাইতেও বড় কথা প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে ও চেষ্টায় রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাখানা থেকে খুঁজে পাওয়া গেছে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘজীবনের পুলিশি গোয়েন্দা রিপোর্ট। এই ভূখ-ে দেশভাগের পর তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান দিনে দিনে কীভাবে স্বাধীনতার অগ্রনায়ক হয়ে উঠছেন তার বিবরণ আছে পাকিস্তানি পুলিশের এই গোয়েন্দা রিপোর্টগুলোতে। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর সুদীর্ঘ ২৩ বছরের স্বাধিকার থেকে স্বায়ত্তশাসন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রায় সকল পর্যায়ে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা নিবিড় নজরদারির আওতায় রাখে। দেশব্যাপী তার প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচি ও অন্যান্য কার্যক্রম তৎকালীন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ (আইবি) সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে। তার নামে রক্ষিত হয় ৪৭টি ব্যক্তিগত ফাইল (পিএফ)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের গোপনীয় শাখা থেকে এই ফাইলগুলো উদ্ধার করে সর্বসাধারণের জন্য তা বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও কর্মকা-ের ওপর রচিত এই গোয়েন্দা নথির বহরও বিশাল। ফলে বই আকারে এর চেহারাও সুবৃহৎ হবে। এই  পুলিশি গোয়েন্দা নথিগুলোকে ১৪ খ-ে বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জাতির জনক  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পক্ষে ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অফ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভলিউম-ওয়ান, ১৯৪৮-১৯৫০’ শিরোনামে প্রথম খ-টি প্রকাশিত হয়েছে। ৫৮২ পৃষ্ঠার প্রথম খ-টি বই আকারে প্রকাশ করেছে হাক্কানি পাবলিশার্স। বইটির প্রথম প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর ২০১৮। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী সমর মজুমদার। বইটির দাম রাখা হয়েছে  নয় শত টাকা।
 পুলিশের গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো ইংরেজিতে সংকলিত বলে ইংরেজিতেই বইটি প্রকাশিত হয়েছে। তবে গোয়েন্দাদের সংগৃহীত অনেক রাজনৈতিক লিফলেট, চিঠিপত্র এর অংশ বলে সেগুলো বাংলায় সংরক্ষিত ছিল। সেগুলোকে অবিকলভাবে বাংলাতেই বইটিতে সংযোজন করা হয়েছে। কীভাবে এই গোয়েন্দা রিপোর্টের খবর মিলল, কীভাবে এই সুবিশাল ঐতিহাসিক তথ্যভা-ার সংগৃহীত হলো, কীভাবে শেষাবধি তা বই আকারে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেয়া হলো তার বিশদ কাহিনি মুখবন্ধে লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী  নিজেই। বইটির প্রথম খ-টি প্রকাশিত হলেও সর্বমোট ১৪ খ-ে বইটি প্রকাশের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ৫৮২ পৃষ্ঠার প্রথম খ-টি প্রকাশিত হলেও আরও ১৩টি খ- প্রকাশের অপেক্ষায়। তবে প্রতিটি খ-ে কী ধরনের তথ্য সন্নিবেশিত হবে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণীও এই প্রথম খ-ে সংযোজন করা হয়েছে। 

দুই.
২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পালিত হবে। ২০২০ সাল হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এই দুই বৃহৎ উৎসবের পূর্বে এই বইটি প্রকাশ এক শুভ প্রচেষ্টা। শুধু তাই-ই নয়, সাধারণ জিজ্ঞাসু মনের পাঠক তো বটেই সকল শ্রেণির গবেষকের জন্য এই বইটি একটি উৎসাহ-উদ্দীপক আয়োজনও বটে।  পুরো ১৪ খ-ে বইটি প্রকাশিত হলে সেটি আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও গবেষকদের জন্য এক মহা উৎসভূমি হয়ে রইবে। বাংলাদেশের গবেষণার ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় গোপন নথিভা-ার থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা জনসম্মুখে উন্মোচন করার রেওয়াজ এত সুবৃহৎ আকারে অতীতে কখনই হয় নাই। সেই বিবেচনায় এই আয়োজন আমাদের গবেষণা ও ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রেও এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ও নবতর প্রচেষ্টা। এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে আরও অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের  জ্ঞানচর্চার পথপ্রদর্শক হয়ে রইবে।
এই তথ্যভা-ার বঙ্গবন্ধুর জীবন রচনার ক্ষেত্রেই শুধু নয়, তার বিস্তৃত জীবন কর্মকা-কে নথিভুক্ত করতে চাইলেও, সূত্র হিসেবে কাজ করবে। আবার এই তথ্যভা-ারের সূত্রে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক গোপন ও অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্রও গবেষকরা চাইলে উন্মোচন করার সুযোগ পাবেন। বলা চলে এটা আমাদের ইতিহাস চর্চার একাডেমিক ক্ষেত্রেও একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। অন্যদিকে রাষ্ট্র কীভাবে কাজ করে, কীভাবে রাষ্ট্রের অদেখা সংগঠনগুলো ছায়ার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অনুসরণ করে, রাষ্ট্র কীভাবে নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তার ছায়াপথও কেউ জানতে চাইলে, পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের এই নিত্যদিনের কর্মকা- থেকে তার হদিস মিলবে। রাষ্ট্রকে চেনার ক্ষেত্রেও এই আয়োজন এক পথনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের এই গোয়েন্দা চোখকে, এই কঠিন-কঠোর নজরদারিকে উপেক্ষা করেই, সকল ভয়-ভীতিকে অগ্রাহ্য করেই কীভাবে জনমানুষের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের রাজনীতি করতে হয় এবং তা জনমানুষ গ্রহণ করে, এই গ্রন্থ থেকে তারও নমুনা খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই বিবেচনায় এই বইটি আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য একটা আকরগ্রন্থও হতে পারে।

তিন. 
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাবে জাতির অগ্রগতি একটা বড় উন্নয়ন বটে। তবে তার চাইতেও বড় উন্নয়ন হচ্ছে জাতির জ্ঞানচর্চার প্রবৃদ্ধি। মুক্ত মন আর খোলা চোখ নিয়ে স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চার সকল সুযোগ সহজলভ্য না হলে একটা জাতি বড় হতে পারে না। ছোট মনের মানুষ, সংকীর্ণ মনের মানুষ দিয়ে বড় জাতি তৈরি হতে পারে না। সে কারণেই মুক্ত জ্ঞানচর্চার সকল সুযোগ উন্মুক্ত করা দরকার সাশ্রয়ী মূল্যেই। এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি আরও কম দামে, আরও সুলভ সংস্করণের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার চ্যালেঞ্জ তাই নিতে হবে খোদ রাষ্ট্রকেই। অচিরেই সকল খ-ের বই আকারে প্রকাশের বিষয়টিও ভাবতে হবে গুরুত্ব দিয়ে।
 যে কোনো বিষয়কে পূর্ণাঙ্গরূপে দেখতে চাইলে তাকে নানা আঙ্গিক ও দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা দরকার। এমনকি শত্রুর চোখেও নিজেকে আবিষ্কার করাও একটা বড় প্রচেষ্টা। যে বঙ্গবন্ধুকে আমরা জাতির জনক হিসেবে দেখছি তাকে শত্রুরা কোন চোখে দেখতেন, কীভাবে মূল্যায়ন করতেন, সেই ভাবনাটা আবিষ্কার করতে পারলে, বঙ্গবন্ধুর শক্তিমত্তা সম্পর্কেও একটা নতুন অবয়ব অঙ্কন করা সম্ভব। পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের চোখে বঙ্গবন্ধুকে জানবার এই সুযোগ সেই সম্ভাবনাও তৈরি করে। সে হিসাবেও এই বইটির প্রকাশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মাত্রা যোগ করে। আবার পাকিস্তানি রাষ্ট্রের কঠোর কঠিন বিধিনিষেধের মধ্যে বঙ্গবন্ধু কী কৌশলে ভিন্নমতকে প্রতিষ্ঠা করছেন, জনগণকে তার মতের পথে আনছেন, সেই কৌশলটাও জানার সুযোগ মিলছে এই তথ্যভা-ার থেকে। আমাদের রাজনীতি ও ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্য সেটাও একটা বড় শিক্ষার সুযোগ তৈরি করছে। সেই হিসাবেও ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অফ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভলিউম-ওয়ান, ১৯৪৮-১৯৫০’ আমাদের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক নতুনতর সংযোজন।

SUMMARY

2175-1.jpg