গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রাম। গোপালগঞ্জ জেলা দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার শেখ লুৎফর রহমানের বাড়ি এই গ্রামেই। আদালতের সেরেস্তাদার কাকে বলে জানো? যিনি আদালতের হিসাব-নিকাশ লিখে রাখেন, তাকে। তাঁর স্ত্রীর নাম সায়েরা খাতুন। তিনি নিজে শহরে থেকে সরকারি চাকরি করেন, আর তাঁর স্ত্রী গ্রামে সন্তানদের নিয়ে ঘর-সংসার করেন। ভাবছো, হঠাৎ গোপালগঞ্জের এই সেরেস্তাদার মশাইকে নিয়ে কেন বলতে বসলাম? আরে, এই লুৎফর রহমানের ছেলেই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের জাতির জনক।
১৭ মার্চ, ১৯২০। এই দিনেই জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বড় দুই বোনের পর তিনি ছিলেন বাবা-মার প্রথম ছেলে। পরে অবশ্য তাঁর আরো দুই বোন আর এক ভাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অন্যান্য ভাই-বোনদের নাম হলো-- বোনদের নাম যথাক্রমে ফাতেমা বেগম, আছিয়া বেগম, হেলেন, লাইলী। আর তাঁর ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের।
আচ্ছা, ভাই বোনদের নাম না হয় হলো, কিন্তু তাঁর অমন সুন্দর নাম শেখ মুজিবুর রহমান কে রেখেছিলেন বলো তো? তাঁর নানা। আর নাম রাখার পরে বলেছিলেন, দেখিস- এই নাম জগৎ জোড়া খ্যাত হবে। দেখেছ, কেমন করে ফলে গেছে তাঁর নানার কথাটি! তবে বাসায় কিন্তু তাঁকে মোটেও এই নামে ডাকা হতো না। তাঁর আব্বু-আম্মু তাঁকে আদর করে ডাকতেন খোকা বলে। আর ভাই বোন আর গ্রামের আর আর সব লোক কী বলে ডাকতো জানো? মিয়া ভাই!
তাঁর প্রথম স্কুল ছিল গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯২৭ সালে সাত বছর বয়সে তিনি প্রথম স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু ভর্তি হলে কী হবে, স্কুলটি ছিল অনেক দূরে, প্রায় সোয়া এক কিলোমিটার দূরে। একদিন তো বেশ বড়োসড়ো এক দুর্ঘটনাই ঘটে গেল। তখন বর্ষাকাল। চারিদিক পানিতে থৈ থৈ। বর্ষাকালে আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে যা হয় আর কী! অতদূরের স্কুল, যাওয়া-আসার জন্য নৌকাই ভরসা। একদিন সেই ভরসার নৌকাই গেল উল্টে। আর মিয়া ভাইও খালের পানিতে পড়ে গেলেন। আর সে কথা যেই তাঁর মা শুনলেন, আর যায় কোথায়! তাঁর আদরের খোকার এতো কষ্ট কী আর তাঁর সহ্য হয়! তিনি দিলেন খোকাকে ঐ স্কুল থেকে ছাড়িয়ে।
না, তাই বলে মিয়া ভাইয়ের পড়াশুনা থেমে থাকেনি। বরং তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে গেলেন গোপালগঞ্জে, নিজের কাছে। ভর্তি করিয়ে দিলেন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। এবার থেকে তিনি গোপালগঞ্জে থেকেই পড়ালেখা করতে শুরু করলেন। সে ১৯২৯ সালের কথা। এর দুবছর পর তিনি আবার স্কুল পাল্টালেন। এবার ভর্তি হলেন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে।
আমাদের দেখা বঙ্গবন্ধু কেমন বলিষ্ঠ, সুঠাম দেহের মানুষ, তাই না? ছোটবেলাতে তিনি কিন্তু ছিলেন ঠিক তার উল্টোটি; একদম রোগা। আর ১৯৩৪ সালে যে তাঁর কী বিপদটাই না হলো! একে হলো বেরিবেরি, মানে ভিটামিন সি-এর অভাবে হাত-পা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। তার উপর চোখের এক জটিল অপারেশন করতে হলো। সব মিলিয়ে মিয়া ভাইয়ের পড়াশোনাই গেল বন্ধ হয়ে। আর ঐ যে বললাম, আগে থেকেই তাঁর স্বাস্থ্য তেমন ভালো ছিল না, তাই তাঁর সেরে উঠতেও অনেক সময় লাগল। ফলাফল, প্রায় চার বছর বন্ধ থাকল তাঁর লেখাপড়া।
দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ১৯৩৭ সালে খোকা আবার স্কুলে ভর্তি হলেন। এবার গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইন্সটিটিউট মিশন স্কুলে। পরে এই মিশনারি স্কুল থেকেই তিনি ম্যাট্রিকুলেশন, মানে এখনকার এসএসসি পাশ করলেন।
এবার তো কলেজ জীবন শুরু হয়ে গেল। তিনি প্রথমে ইসলামিয়া কলেজে আইন বিভাগে ভর্তি হন। সেই কলেজটিতে তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়াশোনা করানো হতো। কিন্তু ১৯৪৭ সালে আবার দেশভাগ হয়ে গেল। বৃটিশরা ভারতবর্ষকে কেটে দুটুকরো করে দিল- ভারত আর পাকিস্তান। কাজে কাজেই আমাদের মিয়া ভাইকেও তার নিজ দেশে ফিরতে হলো। এবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে ভর্তি হলেন। এরপরের ইতিহাস তো তোমরা কম বেশি জানোই। তারচেয়ে চলো, আজকে তাঁর ছোটবেলার আরো কিছু গল্প শুনে আসি।
আগেই তো বলেছি, ছোটবেলাতে আমাদের বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই রোগা। তাই বলে আবার ভেবো না যে তিনি একদমই খাওয়া-দাওয়া করতেন না। তাঁর প্রিয় খাবার কী ছিল জানো? ভাত, মাছের ঝোল আর সবজি। আর খাওয়ার শেষে দুধ-কলা-গুড় না থাকলে তো তাঁর যেন খাওয়াই পূর্ণ হতো না!
তবে মজা হতো খেলার মাঠে। রোগা হলে কী হবে, খেলাধুলার ব্যাপারে তাঁর ছিল দারুণ আগ্রহ। আর প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। আর মজাটা হতো ফুটবল খেলতে গেলেই। এমনিতেই তো তিনি ছিলেন ভীষণ রোগা, তাই যখন তিনি বলে জোরে কিক করতেন, নিজেও উল্টো গড়িয়ে পড়তেন!
ছোট থেকেই তিনি ছিলেন ভারি দয়ালু। কোনোদিন দেখলেন, কোনো ছেলে ভীষণ গরিব, টাকার অভাবে ছাতা কিনতে পারে না, রোদ-বৃষ্টিতে ভারি কষ্ট পায়, অমনি তাঁর ছাতাটা দিয়ে দিতেন। কিংবা টাকার অভাবে কোনো ছেলে বইপত্র কিনতে পারছে না, দিয়ে দিলেন তাঁর নিজের বইপত্র। এমনকি একদিন নাকি এক ছেলেকে ছেঁড়া কাপড় চোপড় পরে থাকতে দেখে নিজের পড়নের কাপড়ই খুলে দিয়ে দিয়েছিলেন