‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে কখন আসবে কবি?/শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/…কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর-কবিতাখানি/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’ ‘স্বাধীনতা- এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় অগ্নিঝরা ফাগুনের ঐতিহাসিক বিকেলকে এভাবেই চিত্রিত করেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। একাত্তরের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রবাদপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে জাতিকে শুনিয়েছিলেন অমর কবিতাখানি। নিরস্ত্র বাঙালিকে করে তুলেছিলেন সশস্ত্র। ডাক দিয়েছিলেন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করার। সময়ের পরিক্রমায় আজ বৃহস্পতিবার সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি অনন্য সাধারণ দিন।
ইতিহাস ভাঙার ইতিহাস : ৪৮ বছর আগের কথা। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষের ভোটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরষ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার আড়ালে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। নির্বাচনে নিরষ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলার মানুষ। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে ৬ মার্চ পর্যন্ত ঘোষিত হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন চলে। ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত পল্টনের জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, যদি ৬ মার্চের মধ্যে সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন না করে, তাহলে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ৭ মার্চ সকাল থেকেই চারদিক থেকে মানুষের ঢল নামে রেসকোর্স ময়দানে। ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ,’ স্লোগানে মুখরিত হয় রেসকোর্স ময়দান। পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে পুরো জাতি তখন স্বাধীনতার জন্য অধীর অপেক্ষায়। শুধু প্রয়োজন একটি ঘোষণার, একটি আহবানের। অবশেষে এলো সেই ঘোষণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নামক মহান কাব্যস্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রগম্ভীর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিপাগল জনতার মহাসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণই মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা। নিজের দেশের হাজার বছরের স্বপ্নপূরণের দিকে এগিয়ে যায় বাঙালি।
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম : স্বাধীনতার জন্য সারা দেশ থেকে ছুটে আসা পিপাসার্ত মানুষের ঢলে একাত্তরের এইদিনে রেসকোর্স ময়দানের চতুর্দিকে জনবিস্ফোরণ ঘটে। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মানুষের ভিড়ে তিলধারণের ক্ষমতা হারায় সে দিনের রেসকোর্স। রাজধানী ঢাকার চতুর্দিকে ভারী অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সামরিক জান্তা রক্তচক্ষু নিয়ে প্রহরায়। আকাশে উড়ছে হানাদারদের যুদ্ধ জঙ্গি বিমান। মুক্তিপাগল বাঙালির সেদিকে ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ নেই। সবার শুধু অপেক্ষা- অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু কখন আসবেন। বঙ্গবন্ধু জনসভায় আসতে একটু বিলম্ব করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হবে কী হবে না এ নিয়ে তখনো রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলছে নেতাদের মধ্যে। বিকেল ঠিক সোয়া ৩টায় সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে ওঠেন তখন বাংলার বীর জনতা বজ্র নির্ঘোষে করতালি ও স্লোগানের মধ্যে তাকে অভিনন্দন জানান। এরপর সৃষ্টি হয় বাঙালির অমর কাব্য। বঙ্গবন্ধুর এই তেজদীপ্ত ঘোষণাই ছিল আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শত নিপীড়ন উপেক্ষা করে বীর বাঙালি অস্ত্র ধারণের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে এ দিনই স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিট তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ও ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন এভাবে, ‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বুঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।’ এরপর পূর্ববর্তী কয়েক দিনের ঘটনাবলি, শাসক শ্রেণির সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়া এবং মুক্তির আকাক্সক্ষায় বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সে দিন উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলার মুক্তিকামী জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘এরপর যদি একটি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।… আমি যদি তোমাদের হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা সব বন্ধ করে দেবে।…আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
প্রাণের মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে ওঠে মুক্তিপাগল বাঙালির। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুর্মুহু স্লোগানে কেঁপে ওঠে বাংলার আকাশ। নড়ে ওঠে হাতের ঝাণ্ডায় তাদের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালি রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র। সে দিন বেতারে সরাসরি বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঐতিহাসিক এই ভাষণটি প্রচারের কথা থাকলেও তা করতে দেয়নি পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। কিন্তু মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে শেখ মুজিবের নির্দেশ, ‘আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, ফৌজদারি আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষেরা কষ্ট না করে, সে জন্য যেসব অন্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি, রেল চলবে। সেক্রেটারিয়েট ও সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তর, ওয়াপদা- কোনো কিছুই চলবে না।
বঙ্গবন্ধুর অমোঘ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে কঠিন সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে দেশকে হানাদারমুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। শুধু অদম্য মনোবলকে সম্বল করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিরস্ত্র বাঙালি মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের আধুনিক সমরসজ্জিত, প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। মৃত্যুপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুঃসাহসে দীপ্ত মুক্তিকামী বাঙালি একাত্তরে মাত্র ৯ মাসে প্রবল পরাক্রমশালী পাক হানাদারদের পরাস্ত-পর্যুদস্ত করে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ, দুঃসাহসিকতা আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি অর্জন করে নিজস্ব মানচিত্র, লাল-সবুজের পতাকা।
পোয়েট অব পলিটিক্স : ৭ মার্চের ভাষণের পর বিশ্ব বঙ্গবন্ধুকে আখ্যায়িত করে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ হিসেবে। আর পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, চতুর মুজিব কৌশলে বাংলার স্বাধীনতা করেছেন। দেখতে দেখতে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের বয়স ৪৮-এ ঠেকেছে। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বিকৃতির নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রের আবহে বদলে ফেলার চেষ্টা হয়েছে স্বাধীনতার অনেক ইতিহাস। কিন্তু অনেক কিছু বদলে গেলেও বদলানো যায়নি শুধু ১৯ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি। বিশ্বের মধ্যে এই একটি মাত্র ভাষণ যা যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেজে চলেছে- কিন্তু ভাষণটির আবেদন এতটুকু কমেনি। প্রতিবছর দিনটিকে জাতি গভীর আবেগ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। আর ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।