টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ির ছেলে, শেখ মুজিব। যিনি বাংলাদেশ ইতিহাসে, বাংলাদেশের স্থপতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিশাহীন জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। জাতীয়তাবোধে জাগ্রত করেছিলেন, তিনি। যার নেতৃত্বে রক্তের বিনিময়ে, জীবন বাজি রেখে, নয় মাস সুসজ্জিত পাক-সৈন্য বাহিনীর সাথে মরন যুদ্ধ করে; লাল-সবুজ পতাকা ছিনিয়ে এনেছেন, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
এই অর্জনের মধ্য দিয়ে টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিব বিশে^র মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাংলাদেশকে। খোকা শেখ মুজিব থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, এক অন্যতম অধ্যায়; তার ছাত্রজীবন ও ছাত্ররাজনীতির দর্শন। কেমন ছিল তার ছাত্রজীবনের রাজনীতি? কি দর্শন ছিল তার? ছাত্ররাজনীতিতে প্রবেশ পূর্বক কর্মকান্ড ছাত্র শেখ মুজিবকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল? সর্বোপরি, ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে তিনি কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন সামাজিক জীবনে, জাতীয় জীবনে সর্বপরি বিশ^ নেতৃত্বে যোগ্যতম নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।
আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারন করি, লালন করি বঙ্গবন্ধরু চেতনা তাদের প্রত্যেককেই গভীরভাবে গ্রহন করতে হবে ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ মুজিব একটি আদর্শের নাম। যে আদর্শের মূলে রয়েছে তীব্র এক অনুভূতি। যার অপর নাম-দেশপ্রেম। বঙ্গবন্ধুর গোটা জীবনকে জাতি হিসেবে হয়তো আমরা এখনো সম্পূর্ন অনুধাবন করতে পারিনি। কিন্তু একজন সাধারন কর্মী হিসেবে তাকে নিয়ে পড়াশুনা করে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাহল- গভীর দেশপ্রেমে তিনি প্রত্যেকটি কাজ শুরু করতেন। মানুষের প্রতি ভালবাসা ছিল তার দেশপ্রেমের বর্হিপ্রকাশ।
৪০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন স্বদেশী আন্দোলন তুঙ্গে। ইংরেজ শাসন আতঙ্ক যখন মানুষকে পাথরের মত স্তব্দ করে দিয়েছিল ঠিক সেই সময়েই বঙ্গবন্ধুর ছাত্র জীবন এক নতুন অধ্যায়ের দিকে মোড় নিচ্ছিল। সুভাষ বসুকে ভালবেসে বঙ্গবন্ধু স্বদেশী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। যা তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে বলেছেন “১৯৩৭ সালে একটু সুস্থ হয়ে, আবার লেখাপড়া শুরু করলাম। আমার আব্বা গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। এই সময়ে আব্বা কাজী আবদুল হামিদ এম.এস.সি মাস্টার সাহেবকে আমাকে পড়াবার জন্য বাসায় রাখলেন। তার জন্য একটা আলাদা ঘরও করে দিলেন।
গোপালগঞ্জের বাড়িটা আমার আব্বাই করেছিলেন। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন। যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলামন বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম। এবং এই চাল বিক্রি করে গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতাম। ঘুরে-ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতাম। আমাকেই অনেক কাজ করতে হত মাস্টার সাহেবের সাথে। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই ‘সেবা সমিতি’র ভার নেই। এবং অনেকদিন পরিচালনা করি। আর একজন মুসলমান মাস্টার সাহেবের কাছেই টাকা পয়সা জমা রাখা হত। তিনি সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক”।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বক্তব্য অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করা ছিল সুচিন্তিত এবং সমাজ সেবামুলক। স্কুলের ছাত্রত্বকালীন সময়ে তিনি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সাথে ছিল অনেক ছাত্র। যারা মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠিয়ে গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার খরচ বহন করতো। বস্ত্রহীন পথচারী শিশুকে নিজের নতুন জামা পরিয়ে দিতেও তিনি কার্পণ্য করতেন না। এ সব ঘটনার মধ্য দিয়ে যে বার্তা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ^াসী কর্মীদের গ্রহন করতে হবে তা হল আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু সমাজসেবামূলক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। সমাজের অবহেলিত, দবিদ্র ছাত্রদের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন, যখন বঙ্গবন্ধু নিজেই ছাত্র ছিলেন। তিনি তার শিক্ষকের কাছ থেকে শুধু পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানই গ্রহন করেননি গ্রহন করেছেন ‘মানবতাবোধ’। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের দায়িত্ব নেওয়ার মত মহৎ গুণ ‘দায়িত্বশীলতা’।
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে এক ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু বলেন “দিন রাত রিলিফের কাজ করে কুল পাই না। লেখাপড়া মোটেই করি না। কলকতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। আব্বা একদিন আমাকে ডেকে বললেন। “বাবা রাজনীতি কর, আপত্তি করব না, পাকিস্তানীর জন্য সংগ্রাম করছো, এতো সুখের কথা। তবে লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবা না। আরেকটা কথা মনে রেখ sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না”। আব্বার একথা কোনদিন আমি ভুলি নাই”।
পিতা শেখ লুৎফুর রহমানের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা বঙ্গবন্ধু তার সমস্ত বিশ^াস দিয়ে গ্রহন করতে পেরেছিলেন। আর তাই, সমস্ত জীবন দিয়ে ‘দায়িত্বশীলতা’ ও ‘দেশপ্রেম’ এই দুটি শব্দকে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পরাধীন দেশকে ও দিশাহীন জাতিকে লক্ষ্যস্থীর করতে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের পাশাপাশি; যে দুটি দুর্লভ গুনাবলি তাকে এগিয়ে নিয়েছিল, দূর্বার গতিতে, তা হল, ‘দায়িত্বশীলতা’ ও ‘দেশপ্রেম’।
বঙ্গবন্ধু অসিম সাহসিকতা দেখাতে পারতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ভয় পেতেন না। এমনিই অনেক দুর্লভ ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি তার ছাত্রজীবন থেকে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বলেন, “১৯৪৪ সালে ছাত্রলীগের এক বাৎসরিক সম্মেলন হবে ঠিক হল। বহুদিন সম্মেলন হয় না। কলকাতায় আমার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল- বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজে কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে সাহস পেত না। আমি সমানভাবে মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগে কাজ করতাম। এই সময় একদিন শহীদ সাহেবের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আনোয়ার সাহেবকে একটা পদ দিতে বলেন, আমি বললাম, কখনোই তা হতে পারে না। সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভাল কর্মীদের জায়গা দেয় না। কোনো হিসাব-নিকাশও কোনোদিন দাখিল করে না। শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, who are you? you are nobody” If I am nobody, then why you have invited me? you have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you sir. I will never come to you agin একথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম”। এই হলো আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আজকের ছাত্ররাই, আগামীর বাংলাদেশ গড়ার যোদ্ধা। যে বাংলাদেশ হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ। যার ভীত হবে দেশপ্রেম। দেশকে, দেশের মানুষকে ভালবেসে যারা একদিন সত্যিকারের ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়বে। ‘জয় বাংলা’কে কেবল শ্লোগানে নয়, রাজনীতিকে ব্যানার ফেস্টুনের রঙিন ছবিতে নয় বরং ‘দায়িত্বশীলতা’ ও ‘দেশপ্রেম’ দিয়ে লালন করবে গভীর প্রাণে। প্রতিটি কর্মের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
কেয়া চৌধুরী
সমাজ কর্মী ও সংসদ-সদস্য