ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এক মহিয়সী নারী

এইচ এম এ হক বাপ্পি
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান। তিনি জীবনের সবটুকু সময় ব্যয় করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বার বার বঙ্গবন্ধুকে কারবরণ করতে হয়েছে। অনেক জেল জুলুম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন এবং অদৃশ্য এক ছায়া হয়ে এসব কাজে সহায়তা করেছেন তার সহধর্মীনী বঙ্গ জননী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রমে তার অবদান ও ত্যাগের কথা আসলে ইতিহাসে সে সকম স্থান পায় নি। হয়ত তিনি বঙ্গবন্ধুর জ্যোতিময় জীবনের খ্যাতির আড়ালে পড়ে গেছেন। আর না হয় ইতিহাস তার অবদান সঠিকভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রজনৈতিক জীবনে আসার আগেই ফাজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর জীবনে আসেন। তখন বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়ার খোকা ছিলেন। সেখান থেকে রাষ্ট্রনায়ক, স্বাধীনতার মহানায়ক এবং জাতির জনক হওয়ার পেছনে যিনি পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি হলেন বেগম মুজিব। তিনি বঙ্গবন্ধুকে তার রাজনৈতিক জীবনের দু:সময় শুধু সাহস যোগাননি। নানা ভাবে সহয়তাও করেছেন। দেখা গেছে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নিজেই অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দলে ও জন্য দেশের জন্য অনেক ত্যাগ সহ্য করেছেন। বঙ্গবন্ধু জেলে গেছেন বঙ্গমাতা সন্তানদের নিয়ে সংসার সামাল দিয়েছেন। কোনো দিন এমন অভিযোগ করেননি যে সারাটা জীবন শুধু দেশ আর দেশের মানুষের জন্য জীবনটাকে উৎসর্গ করে যাচ্ছেন। একবারও কি সংসার আর সন্তানদের কথা ভেবেছেন। বঙ্গমাতা এ প্রশ্ন তুললে যদিও বঙ্গবন্ধু তার অবস্থান থেকে সরে আসতেন না। তিনি বাঙালির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে যেতেনে। তবে তখন তার পরিবার পরিজনের কথাও ভাবতে হত। হয়ত তখন এ আন্দোলন এত বেগবান হত না। কিন্তু সংসার সন্তান নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কোনো দিন ভাবতে হয়নি। তাই আমরণ তিনি দেশ ও জাতিকে নিয়ে ভাবতে পেরেছেন। যার ফলে আমরা পেয়েছি আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ্ ।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে শুধু সংসারই সামলাননি। দক্ষতার সঙ্গে সংগঠনেরও অনেক কিছু সামলিয়েছেন। সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ক্রোন্দল চলছে। ছাত্রলীগ ভেঙ্গে দুগ্রুপ হয়ে যাচ্ছে। কোনভাবেই ছাত্রলীগ যেন না ভাঙ্গে। সেই ভাঙ্গন ঠেকাতে নিজের গলার নেকলেজ খুলে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে তিনি তার সন্তানের মতই ভালবাসতেন। সন্তানের ত্যাক্ততায় যেমন বিরক্ত হননি তেমনি সংগঠনের হাজারো নেতা কমীদের সামলিয়েছেন সহ্য করেছেন ।
যুদ্ধকালীন সময় তার অসামান্য অবদানের পরিমাপ করাও খুবই কষ্টের। অনেকে বলে থাকেন যে , প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনেই আছে একজন নারীর অবদান। আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিব এর বর্ণিল জীবনের পেছনে বঙ্গ মাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি শুধুই বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাতা হিসেবেই পরিচিত , কিন্তুূ এই মহান নারী দেশের জন্য অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। তা অজানাই রয়ে গেছে আমাদের এই প্রজন্মের কাছে।
১৯৩০ সালের ৮ই আগস্ট বেগম মুজিব ( ডাকনাম রেনু ) গোপালগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। মিশনারী স্কুল এ তার শিক্ষা জীবন শুরু। মাত্র পাচ বছর বয়সে তিনি মাতা পিতা দুজনকেই হারান। ১৯৪১ সালে ১১ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন জাতির পিতা জেলে , তখন আইয়ুব খান গণমানুষের প্রবল আন্দোলনের মুখে দিশে হারা হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেয়ার আহবান জানায়। ওই বৈঠকে যোগ দিতে হলে বঙ্গবন্ধুকে পেরোলে মুক্তি নিয়ে লাহোর যেতে হবে। তখনকার সময়ের জাদরেল পলিটেসিয়ান আতাউর রহমান , আবুল মনসুর , তোফাজ্জল হোসেন প্রমুখ , বঙ্গবন্ধুর উপর চাপও প্রয়গ করেন বৈঠকে বসার জন্যে। কিন্তুূ বেগম মুজিব সরাসরি ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বৈঠকে যোগ না দিতে অনুরোধ জানান। জাতির পিতা সেদিন তার সহধর্মিনীর আহবানে সাড়া দিয়ে বৈঠকের না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইতিহাস সাক্ষী , বেগম মুজিবের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর সেই বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের জন্য আইয়ুব খান জনরোষ থেকে বাচতে , ওয়ান মেন ওয়ান ভোট ” মেনে নিয়ে নির্বাচন দিতে বাঁধ্য হয় এবং এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা তরান্নিত হয়।
১৯৭১ সালের কথা। দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করল। বাংলার মানুষের ঠিকানা ৩২ নম্বরের বাড়ি।স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু এখানে হওয়ায় সবাই ছুটে আসতেন এই ঠিকানায়। আর বঙ্গ জননী দুহাতে সামাল দিতেন এসব মানুষের খাওয়া পরা। এর ভিতরই তার আনন্দছিল। স্বাধীন বাংলার সপ্ন ফুটে উঠত তার হাসি মুখে।
স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রাম শুরু হলো। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেন। গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গমাতাকে বললেন, তোমরা আমাকে নিয়ে ভেবনা। আমার অবর্তমানে দেশের স্বাধীনতা আন্দলোনের দিক নির্দেশনা দিবে। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলবে। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে এতদিন বেগম মুজিবের ওপর বঙ্গবন্ধুরও আস্থা ছিল। বঙ্গবন্ধু জানতেন তিনি যে আন্দোলনের সূচনা করেছেন তার অবর্তমানে সে আন্দোলন থেমে থাকবে না।
৭১ এ বঙ্গজননী সন্তানদের নিয়ে গৃহবন্ধি হলেও গোপনে গোপনে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাহস যুগিয়েছেন। সঠিক পথ দেখিয়েছেন।
মহানমুক্তিযুদ্ধে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এর অসামান্য অবদানের পরিমাপ করা খুবই কঠিন। একদিকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। অন্যদিকে দুই ছেলে শেখ জামাল এবং শেখ কামাল পাকিস্তানি আর্মিদের বিরোদ্ধে জীবন বাজী রেখে লড়াই করছে। ঘরে সন্তান সম্ভাবা কন্না শেখ হাসিনা , কিন্তুূ তারপরও তিনি দমেননি। নিজের বিয়ের সোনা বেচে মুক্তিযোদ্ধের জন্য টাকা পাঠাতেন বেগম মুজিব। মুক্তিযোদ্ধাদের মঙ্গলের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতেন সারাক্ষণ।
নয়মাসের যুদ্ধ শেষে বঙ্গজননী মুক্ত হলেন। সন্তানদের নিয়ে ফিরে এলেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে। আবার বাড়িটি জনসমুদ্রে রূপনিল। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। ১০ জুন ১৯৭২ সালে। তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হলেন। বঙ্গজননী ফার্স্টলেডি হলেন। কিন্ত তারা রাষ্ট্রীয় বাস ভবনে উঠলেন না। তাদের সেই পুরোনো ঠিকানা ৩২ নম্বরের বাড়ি। বঙ্গজননী সেই বঙ্গজননী। তার ভেতর নেই কোন পরিবর্তন। আগেও তিনি মোটা পাড়ের শাড়ি পরতেন এখনো তাই। আগেও বাড়ির খাবার ঘর সবার জন্য উম্মুক্ত ছিল এখনো সেই দরজা উম্মুক্ত।
এবি এম মূসা ভাই তার এক কলামে এভাবেই লিখেছিলেন‘বঙ্গবন্ধু যখন দেশের প্রেসিডেন্ট তখন একদিন তার বাড়িতে গেলাম তার সঙ্গে ে দখা করতে। ভাবি পানের থালাটা হাতে নিয়ে সামনে এলেন। পান বানিয়ে একখানা আমার দিকে দিলেন।আর একখানা নিজে মুখে দিলেন।’ এথেকেই প্রমানিত হয় বেগম মুজিব ফার্স্টলেডি হলেও গ্রামের সেই অথিতিয়তা ধরে রেখেছিলেন। তার আচার আচারণে প্রকাশ পেয়েছিল তিনি ফার্স্টলেডি নন তিনি গোপালগঞ্জের পুত্রবধূ।তিনি সর্বদা মায়ের মতোই ছিলেন। তার কণ্ঠেছিল মমতা মাখানো মাতৃ¯েœহ। এমনকি তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন অনুষ্ঠানে বাইে ও যেতেও পছন্দ করতেন না। অনেক সময় বঙ্গবন্ধু জোর করে নিয়ে যেতেন। সে সময়ও তার কোন পরিবর্তন ছিল না। সাদামাটা ভাবেই যেতেন। কোন বিদেশি মেহমান এলেও তাকে দেখে অবাক হতেন। ঐশ্বর্যের ভিতর থেকেও এত নির্লোভ নিরহংকারি। পরে তারা বুঝতে পারতেন এ আসলেই বাঙালি জাতির মাতা। মায়ের মতই সর্বক্ষেত্রে। তখন সবাই মুগ্ধ হতেন। তার আদর্শ দেখে। যে এমন নারী খুঁজে পাওয়া দুস্কর। যে ক্ষমতার ভেতর থেকেও সাধারণ জীবন যাপন করছেন।
বেগম মুজিব ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী , তিনি চাইলেন অনেক কিছুই করতে পারতেন। কিন্তু অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। তিনি তা করেননি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার খুনি চক্র শুধু একটি ব্যাঙ্ক হিসেবই পেয়েছিল জাতির পিতার নামে , আর তাতে জমা ছিলো মুজিব পরিবারের সঞ্চয়ের পাঁচশত টাকা !
বঙ্গবন্ধু যেমন হিমালয়ের মতো অটল ছিলেন ঠিক তেমনি তার সহধর্মিনীও ছিলেন প্রচ- সাহসের অধিকারী। ৭৫ এর ১৫ই আগস্ট গুলাগুলির আওয়াজ শুনে বেগম মুজিব ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন ঘাতকের গুলিতে নিহত তার প্রীয় স্বামীর লাশ সিড়িতে পড়ে আছে। তিনি কাপুরুষের মতো তখন প্রাণ ভিক্ষা চাননি। ভরাট কন্ঠে বীরের মতো বললেন,‘তোমরা আমাকে এখানেই হত্যা করো!
জাতির পিতার পরিবার তাদের জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে নিজেদের উপর অর্পিত দায়ীত্ব পালন করে গেছেন। বেগম মুজিবের জীবনী তার জ্বলন্ত সাক্ষ্য বহন করে।

SUMMARY

2168-1.jpeg