আঙিনায় বটবৃক্ষ হয় না। বটবৃক্ষের জন্য চাই তার পায়ের নিচে বিশাল প্রান্তর মাথার উপর অসীম আকাশ, আর চাই সূর্যের আলোক সম্পাত।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এক জাতি হয়েও বাঙালি কখনো এক হতে পারেনি। বাংলার মানুষ এক হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বাংলার মানুষ সুশাসিত হবার স্বপ্ন তাই ম্লান হয়েছে বারবার দুর্ভাগ্যে। বাংলার শ্যামল প্রান্তর বড় দীর্ঘকাল অপেক্ষা করেছিলো এক মহামুনি বটবৃক্ষের জন্য। বাংলার ইতিহাস হাজার বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলো এক মহা নায়কের জন্য। শেখ মুজিব সফল রাজনীতিক পুরুষ যিনি, তাঁর অনন্য সাধারণ নেতৃত্ব জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিকশিত করেছিলেন গোড়ামির আর কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে জাতিকে একদেহ এক আত্মায় সমর্পিত করেছিলেন, জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে নামিয়েছিলেন।
শৃঙ্খলিত বঙ্গজননী শতাব্দীর পর শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করেছিলেন তাঁর সেই মহামুনি বটবৃক্ষ, আমাদের ইতিহাসের সেই মহানায়ক আমাদের দীর্ঘ অমাবশ্যার শেষে উদিত সেই সূর্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমাহসহ তেরশ' নদী থেকে জাগরিত পলল মৃত্তিকার এই বাংলাদেশের প্রায় সাতান্ন হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত বিশাল এ বাংলাদেশ, কোটি কোটি অগণিত মানুষের নাড়ি পোতা এ বাংলাদেশ।
রামছাড়া যেমন রামায়ন রচনা করা যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলার ইতিহাস লেখা যায় না। অতীশ দীপঙ্করের বাংলা থেকে তীতুমির-শরীয়াতুল্লা, দেশবন্ধু, ফজলুল হক, শরৎ বসু, আবুল হাশিম, মাওলানা ভাসানীর বাংলার রাজনীতির যে ধারাবাহিকতা, শেখ মুজিবের রাজনীতিতে সফল এবং শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার। পলাশী থেকে তীতুমিরের বাঁশের কেল্লা, অনেক রক্তদান পরাজয় বিপর্যয়ের মধ্য থেকে বাঙালির সৌর্য ও জয়ের প্রতীক শেখ মুজিবের অভ্যুদয়।
এক বিশাল একটি ভূমি জুড়ে, এতো কোটি মানুষকে এক সূত্রে, এক মন্ত্রে, এক সংকল্পে যিনি হাজার বছরের ভিতর প্রথম গ্রথিত করতে পেরেছিলেন শৃঙ্খল মুক্তির যুদ্ধে প্রণিত করেছিলেন এবং বিজয় এনে দিয়েছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ রাষ্ট্রের স্থপতি। এ রাষ্ট্রের জনক তিনি। জয় বাংলার রণমন্ত্রে যুদ্ধের যে সূচনা, যে রণহুঙ্কার যুদ্ধের বিজয়কে করে নিশ্চিত; যে জয়ধ্বনি রাষ্ট্রকে গণমানুষের প্রকৃত একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রতীক হয়ে আছে ও থাকবে। সেই জয়বাংলার উদগতা পুরুষকে আমি জানাই আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন এ দেশের সকল মানুষের অনুরাগ ও আনুগত্য শক্তি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং অনন্য সাধারণ দেশ নায়ক। ১৯৭১ সালের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সর্বজনীন নেতা নন্দিত কবি জসিম উদ্দীন স্বরচিত এক কবিতায় তাঁকে লক্ষ্য করে ওই সময়ে বলেন-বাংলাদেশের মকুটহীন ''তুমিই প্রমূর্তরাজ।'' কোটি কোটি বাঙালি তাঁকেই অনুসরণ করেছে। তিনি বাঙালি মন-মনস।
বৃটিশ বিরোধী শত সহস্র বিপ্লব, যুদ্ধ হয়েছে আমাদের ভূ-খণ্ডে স্বাধীনতার জন্য; কিন্তু এ সবই ছিলো খণ্ডিত, ক্ষুদ্র, ক্ষণস্থায়ী এবং পরিণামে ব্যর্থ ও পরাজয় খিন্মা কতবীর, কত যোদ্ধা, কত সন্তান প্রাণ দিয়েছে। তাঁদের রক্তে আজো ভিজে আছে বাংলার মাটি। সে সব বিপ্লব বিদ্রোহ যুদ্ধের রক্তে ভেজা খণ্ড খণ্ড অঞ্চলকে বিশাল ভূমিতে পরিণত করে বিচ্ছিন্ন কোটি কোটি মানুষকে একটি মানুষে পরিণত করে, একাত্তরের যুদ্ধে পাঠিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধু এ জনগোষ্ঠীকে একটি জাতিতে পরিণত করেন। তাই তিনি জাতির পিতা এবং নিজের শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত ঢেলেছেন বঙ্গজননীর শ্যামল আঁচলে বাংলার মাটিতে। বাংলার প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তার শেষ আঘাত হানে বাংলারই শ্রেষ্ঠ সন্তানের বুকে; কারণ, তারা জানে বাঙালির এ বিজয় আর কখনো পরাজিত হবার নয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে আমরা হারিয়েছি বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যারা এ স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি সেসব রক্ত পিপাসু প্রতারকেরা সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর রক্তের ধারাকে। যিনি এদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এ জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, সে সংবিধানেই তাঁর হত্যার বিচার অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো।
কঠোরতার অভাবে দলীয় কর্মী ও সমর্থকের ছদ্মবেশে স্বার্থপর ও সুবিধাবাদী চক্রের বাড়াবাড়ি, সরকারি সম্পত্তি দখল এবং দুর্নীতি লুটপাট, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ সরকারের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সুযোগেই একালের মীরজাফর মোশতাক এবং সেনাবাহিনী থেকে অপসারিত তার আত্মীয় কর্নেল (অবঃ) রশিদ, কর্নেল (অবঃ) ফারুক এবং প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর, আমলা মাহবুবুল আলম চাষী ও তাদের সঙ্গীরা সংগঠিত হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। অন্যদিকে জাসদের বিভ্রান্ত ও অ্যাডভেঞ্চারিস্ট অংশ তাদের তথা কথিত সেনাবাহিনী, সিরাজ শিকদারের চরমপন্থি সর্বহারা এদের বিচ্ছিন্ন উপদল এবং গোপনে নানা নামে স্বাধীনতা বিরোধী মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত প্রচার পুস্তিকা লিফলেট বিতরণ, হুইসপারিং ক্যাম্পেনের মাধ্যমে মানুষের মনকে বিষিয়ে দেয়া ছাড়াও অবৈধ অস্ত্রের মাধ্যমে থানা লুট, গুদাম পুড়িয়ে দেয়া, আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হত্যার মাধ্যমে নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এ অবস্থার সুযোগে মোশতাক চক্র সিআইএ, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা এবং সেনাবাহিনীর বিদেশী চর ও বাংলাদেশের মৌলিক দর্শন বিরোধী অংশটি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। ক্ষমতায় বসে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত দেশদ্রোহী অংশের প্রহরায় ও খবরদারিতে খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তার পেছনে অপেক্ষায় থাকে ভবিষ্যৎ ক্ষমতার ভাগীদাররা। আসলে এ বহুস্তর বিশিষ্ট নিষ্ঠুর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের খেলায় মোশতাকের মতো ধূর্তলোকও ছিলো শিমণ্ডিত।
মুজিব স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে বিশ্বাস ও চেতনায় আপ্লুত হয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, লড়াইয়ের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছিলেন। তাই তিনি আজীবনের ধ্যান-জ্ঞান, বিশ্বাসের অবস্থানটি মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনেও পরিবর্তন করেননি। তাই আমি স্বাধীন দেশের মানুষ। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠে। তাই তাঁর পদতলে নৈবদ্য দিতে অন্ততঃ আমি কুণ্ঠিত নই। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালির গন্তব্য স্থির হয় একটি স্বাধীনতা। বাংলার প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তার শেষ আঘাত হানে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। কারণ তারা জানে বাঙালির এ বিজয় আর কখনো পরাজিত হবে না।
মুজিব কি ছিলেন তা বর্তমান বাংলাদেশে বুঝবার অবকাশ নেই। এ মুজিবের জন্য মসজিদে শিরনি দেয়া হতো, মন্দিরে গীর্জায়, প্যাগোডায় প্রকাশ্যে গোপনে প্রার্থনা করা হতো। বাংলার মুসলিম আবাল বৃদ্ধ-বনিতা মুজিবের মঙ্গল কামনায় নফল নামাজ পড়তো, রোজা রাখতো। পীরের মাজারে মানত করতো।
শেখ মুজিবের মৃত্যু নেই। তিনি মৃত্যুঞ্জয়। কবির ভাষায় বলা চলে-
যতোদিন রবে গৌরি মেঘনা, গঙ্গা যমুনা বহমান
ততোদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে আজ শত্রুর বন্যা রক্ত গঙ্গা বহমান
তবু নাহি ভয় হবে- হবে জয় মুজিবুর রহমান।
জাতির জনকের ৩৯তম প্রয়াণ দিবসে আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে জানাচ্ছি আমার প্রাণঢালা শ্রদ্ধা।
লেখক পরিচিতি : সমালোচক, সামাজিক ও সংস্কৃতি সংগঠক, অধ্যাপক পাড়া, চাঁদপুর।