১৫ আগস্ট বাঙালির জাতির জন্য এমন একটি কালো দিন যা ইতিহাসের নির্মমতাকেও হার মানিয়েছে। ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা ঘাতকদের নির্মম বুলেটের শিকার হয়ে শাহাদাতবরণ করেন। আর সেই কালো নির্মমতার জাতির জনকের হত্যার এই দিনটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফেশিয়ারি জেনারেল জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার অনুসারীরা ঘটা করে তার জন্মদিন পালন করেন। একজন মানুষের মৃত্যুর দিন অনেকের জন্ম হতে পারে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার জন্ম তারিখ কি ১৫ আগস্ট ছিলো? তিনি ১৯৯১ সালে যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দায়িত্ব পালন করেন তখন তার জীবনীতে জন্ম তারিখ কত প্রকাশ করেছিলেন নিশ্চয়তা কারো অজানা নয়। এরপরও স্কুল সার্টিফিকেটে অন্য তারিখ। এসব বিভ্রান্তিমূলক তারিখ নিয়েই তিনি গত ক'বছর ধরে জন্মদিন পালন করছেন। এমনকি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী হিসেবে জিয়ার জীবিতকালে কখনো ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন তিনি পালন করেছেন এমন নজির নেই। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য জাতির জনকের এই শাহাদাতবার্ষিকীতে বিএনপি নেত্রী বেগম খালো জিয়া ও তার অনুসারীরা জাতির শোকের দিনটি নিয়ে উপহাস হাসি, আনন্দ করেন। যা এ প্রজন্মের একজন হয়ে দেখতে হচ্ছে। অথচ বেগম জিয়া বা বিএনপির নেতা নেত্রীদের এতটুকু অনুধাবন করা উচিত বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে জেনারেল জিয়া ও তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসীন হতেন না। বিএনপির বড় বড় নেতা আমলারা মন্ত্রী হতেন না। যদি আজ পূর্ব পাকিস্তান থাকতো তাহলে কি জিয়া-এরশাদ-খালেদা রাষ্ট্র প্রধান হতে পারতেন?
১৫ আগস্ট আসলে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করি। কেননা একটি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর যে ত্যাগ ও অবদান তা পৃথিবীর কোনো সংগ্রামী নেতা বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন নি। পাকিস্তানের সুদীর্ঘ ২৩ বছরে ১৪ বার গ্রেফতার প্রায় ১৩ বছর কারাবরণ ও দু'বার ফাঁসির মঞ্চে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ছিল প্রায় সাত কোটি বাঙালির অনুপ্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয় চেতনার এক প্রজ্জ্বলিত শিখা। তিনি ছিলেন সমগ্র বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়ক। তাঁর সুদক্ষ ও সফল নেতৃত্বের ফসল হচ্ছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাল-সবুজের একটি পতাকা। পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে বাঙালি জাতির নিজস্ব পরিচয় ও ঠিকানা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগ্রামী জীবন, সাহস, নেতৃত্ব, ত্যাগ ও মানবিক গুণাবলি লিখে কখনো শেষ করা যাবে না। তিনি ছিলেন সারা বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দিশারি। এক আপোসহীন নেতা ও রাজনীতিবিদ। এ জন্যেই বিশ্বের তিনি ''রাজনীতির কবি' কিংবা ''সুপারম্যান' হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিক সিরিল ডান বলেছেন, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা, যিনি রক্তে, বর্ণে ভাষায়, কৃষ্টিতে এবং জন্মসূত্রেও ছিলেন খাঁটি বাঙালি। জনগণকে নেতৃত্বদানের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সাহস তাকে এ যুগের এক বিরল মহানায়কে রূপান্তর করেছে। বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি বাঙালি হওয়ায় তিনি বাঙালির নাড়ির স্পন্দন, আবেগ ও আকাক্সক্ষা মনে প্রাণে উপলব্ধি করতেন। তার এ উপলব্ধি পরবর্তী সময়ে বাঙালির আকাক্সক্ষার ও মুক্তি সংগ্রামের একমাত্র পথ প্রদর্শক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনীতিবিদ বা মুক্তিসংগ্রামের অগ্রনায়কই ছিলেন না, ছিলেন এক নরম ও কোমল হৃদয়ের উদার মানুষ। ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার সমাজতান্ত্রিক নেতা ফিদেল কাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি হিমালয় কখনো দেখিনি। আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি, সাহস ও ব্যক্তিত্বে এ মানুষটি হিমালয়ের মতোই উঁচু। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ব্রিটিশ মানবতাবাদী আন্দোলনের অগ্রনায়ক লর্ড ফেন্নার ব্রোকওয়ে মন্তব্য করছিলেন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও আয়ারল্যান্ডের জর্জ ডি ভেলোরার চেয়েও মহান ও অনন্য। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি একই সঙ্গে একটি স্বাধীন জাতি ও স্বাধীন দেশের জনক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যতো কবিতা ছড়া লিখা হয়েছে পৃথিবীর অন্য কোনো নেতা বা জাতির জনককে নিয়ে এতো লিখা হয়নি।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। এমনি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বাঙালি জাতি যখন অগ্রসরমান, ঠিক তখনই আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কুচক্রী মহল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের আঁধারে অত্যন্ত নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বাঙালির জাতির ইতিহাসে ১৫ আগস্টের মতো ঘৃন্যতম ও কলঙ্কজনক দিন আর নেই। তারপর শুরু হয় বাঙালির গর্বের ধন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির নানা রকম অপকৌশল। পুরস্কৃত করা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের। বঙ্গবন্ধুকে ''খলনায়ক' বানানোর এমন কোনো চেষ্টা বাদ যায়নি বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারি জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার সরকার করেনি। শুধু কি তাই? বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ১৫ আগস্টের মতো আরোকটি ২১ আগস্ট ঘটানো হয়। শেখ হাসিনাকে বহুবার হত্যা প্রচেষ্টা চালানো হয়।
সবচে' বড় বিষয় হচ্ছে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। আর আমাদের রাজনীতিবিদদের বড় দোষ হচ্ছে তাঁরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ভুলে যান। যে কারণে তারা নিজেরাও ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে নির্মমতার শিকার হন। ঘাতকরা ১৫ আগস্ট হত্যা করে বঙ্গবন্ধুসহ বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালকে। ১৯৭৫ সালে এই দিনে ঘটে যাওয়া পৃথিবীর এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে ববি, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি এবং আবদুল নাঈম ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ঘনিষ্ঠজন। আর এই হত্যা ও নির্মমতার নায়করা কেউ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেনি কিংবা যারা বেঁচে আছে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। কুকুরের জীবনের চেয়েও খারাপ জীবন তারা পালিয়ে পালিয়ে কাটাচ্ছে। ইতিহাস তাদের কাউকে ক্ষমা করেনি।
অনেক চড়াই-উত্তরাইয়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সব অন্ধকার দূরে ঠেলে বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে মুক্তির পথে এগিয়ে চলেছেন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আরো এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্ব ও দর্শন যেমন সমগ্র বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে সফলতা এনে দিয়েছিল, তেমনি তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান দিন বদলের সংগ্রামেও বাঙালি জাতি আজ একতাবদ্ধ। স্বাধীনতা সংগ্রামের চেয়েও শোষণ-বঞ্চনা মুক্ত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের সংগ্রাম আরো কঠিন। বঙ্গবন্ধুর এ সংগ্রামী চেতনা ও আদর্শের সে স্বপ্ন পূরণে এ সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।
যতদিন পদ্মা-মেঘনা-যমুনা থাকবে, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন এ দেশের প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব চির অম্লান বাঙালি চেতনায় অনির্বাণ শিখা হিসেবে প্রজ্বলিত থাকবেন এবং সভ্যতার শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিব নামটি উচ্চারিত হবে।
জাতির জনকের ৩৯তম শাহাদতবার্ষিকী আমাদের এই হোক প্রত্যাশা ১৫ ও ২১ আগস্টের মতো যেন আর কোনো জঘন্যতম অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে লক্ষ্যে বাঙালি জাতিকে আজ ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কেননা ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট একই সূত্রে গাঁথা। জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আগামী বিশ্বে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদেরকে সে যুদ্ধে একাত্ম হয়ে সময়ের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন সার্থক হবে।
লেখক পরিচিতি : সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, চাঁদপুর।