ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
মানুষের মনন-মানস নির্মাণে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অবদান অসামান্য। উন্নত কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বলে নির্মিত চেতনার মানুষ অন্য অনেকের জন্যে আলোর দিশারী হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই রকম এক বিশ্বজয়ী আলোক দিশারী যার মানস-চেতনা নির্মিত হয়েছিলো এদেশের সোঁদা মাটির গন্ধ আর কলকাতার আধুনিক নাগরিক সংস্কৃতির অপূর্ব মিশেলে।
বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন কাটে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলার আলো-বায়ূ-জলে। ফলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ-কাব্যে উঠে এসেছে অনেক শিকড়ের শব্দ। নাগরিক শব্দের আয়োজনে সেইসব শিকড়ের সোঁদা-মাটির ঘ্রাণমাখা শব্দ যখন মিশে যায় একাত্ম হয়ে তখন মনে হয় কে যেন প্রাণের গভীরে ডাক দিয়ে গেলো। তার সেই গভীর ডাকে ফুটে উঠে তার চরিত্রের অসামান্য নেতৃত্বগুণ, অবিসংবাদিত হৃদ্-নৈকট্য। ফলে যে একবার তার কাছে এসেছে, সান্নিধ্য পেয়েণে, তার পক্ষে দূরে সরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিলো।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৩ সালের দিকে কলকাতা এসে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। অচেনা এক ভিনদেশী রচিত স্মৃতিকথা হতে পাওয়া যায়- তখন মধ্য চল্লিশের দিকে কলকাতার সাংস্কৃতিক সমুদ্র অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিলো। সেই সাংস্কৃতিক সমুদ্রে যারাই অবগাহন করেছেন-তারাই হয়ে উঠেছেন বিশাল মাপের মানুষ। তখন কলকাতা মাতাতেন কবিদের যুবরাজ রবীন্দ্রনাথ, অহীন্দ্র চৌধুরী, কানন বালা, শিশির ভাদুড়ী, জগন্ময় মিত্র এবং পরে কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। শেখ মুজিব এ রকম একটা সাংস্কৃতিক সমুদ্রে এসে নিজের অন্তর-সত্ত্বার নির্মাণকে আরো মার্জিত এবং দৃঢ় করে নিলেন। এরই মধ্যে তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দীক্ষা নেয়া হয়ে গেছে। তার গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আবার মাঝে মাঝে শেখ মুজিব বামপন্থী তাত্ত্বিক আবুল হাশিমের রাজনৈতিক ক্লাসেরও ছাত্র ছিলেন। আবুল হাশিমের জবানিতে পাওয়া যায়- শেখ মুজিব তাত্ত্বিক ক্লাস অপেক্ষা কর্মকে প্রাধান্য দিতেন বেশি।
অচেনা ভিনদেশী লেখকের স্মৃতি কথায় পাওয়া যায়, তখন চাঁদপুর ঘাট হয়ে গোয়ালন্দ দিয়ে কলকাতা যেতে হতো তাকে প্রায়শই। সে লেখক চট্টগ্রামের পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কলকাতার ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হলেন। যাত্রা পথে চাঁদপুর ঘাটে মিষ্টি কিনে যেতেন। চাঁদপুর ঘাট তখন অত্যন্ত প্রাণবন্ত ছিলো। সে তুলনায় গোয়ালন্দ ঘাট অত্যন্ত সাদামাটা ছিলো। যে সময়ের কথা অবতারণা করা হচ্ছে সে সময় শেখ মুজিব লিকলিকে হাল্কা পাতলা গড়নের ছিলেন। পরনে কালো শেরওয়ানী আর পাঞ্জাবী। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে শেখ মুজিব মহাত্মা গান্ধীর অহিংসনীতির সমর্থক এবং নেতাজী সুভাষ বসুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনুসারী ছিলেন। যদিও এ দুটি বিপরীত ধারা, তবুও শেখ মুজিবের মধ্যে অত্যন্ত সুযতভাবে অহিংসা আর অসাম্প্রদায়িক সহিংস আন্দোলন শিকড় গেঁড়ে বসে। ফলশ্রুতিতে শেখ মুজিব একদিকে যেমন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানকে অচল করার দূরদর্শিতা দেখান তেমনি অন্যদিকে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি প্রয়োজনে যে রক্ত বাঙালি বিসর্জন দিয়েছে তার চেয়ে আরো অধিক রক্ত বিসর্জনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এতে শেখ মুজিবের চেতনা ও চরিত্রের দৃঢ়তা অত্যন্ত নিপুনভাবে পরিস্ফূটিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাংস্কৃতিক মানস অত্যন্ত সুদৃঢ় ও উন্নত ছিলো বলেই ১৯৫৬ সালে তাঁর স্বল্পায়ূ মন্ত্রীত্বের কালে তিনি ঢাকায় চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর এ সিদ্ধান্ত এতোটাই দূরদর্শী ছিলো যে-এ প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাটক মঞ্চায়নে বাধা অপসারণের জন্যে তিনি বিনোদন কর সম্পর্কিত জটিলতা দূর করেন। বঙ্গবন্ধুর এ বদান্যতা তৈরি হয় তাঁর সাংস্কৃতিক মানসের নির্মাণ সুদৃঢ় ছিলো বলেই।
রাজনীতির ক্ষেত্রে বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ তাঁকে এতোটাই আচ্ছন্ন করেছিলো যে, তিনি স্বাধীনতার অনেক আগে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্মরণ সভায় প্রকাশ্যে বলেন-এ পূর্ব বাংলা ভূখণ্ডের নাম হবে বাংলাদেশ। কলকাতার সাংস্কৃতিক সমুদ্রে তার অবগাহন তাকে একজন প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারী হিসেবে গড়ে তোলে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৬৩ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে পরিণত করেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বে তার সাংস্কৃতিক মানস-চেতনার নির্মাণ এতোটাই সহায়ক ছিলো যে-তিনি স্বপ্ন দেখেছেন অসাম্প্রদায়িক, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত এক স্বাধীন ভূ-খণ্ড বাংলাদেশের। তাই উপরোক্ত চারটি নিয়ামকের আদর্শকে বলা হয় মুজিববাদ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একজন আদর্শ ভাষণ-বক্তা এবং কুশল-কাব্যের পারদর্শী নির্মাতা। তাঁর শব্দ চয়ন, প্রক্ষেপিত শব্দের আবেগ ও ধ্বনিময়তা এবং সর্বোপরি তাঁর অনুপম ব্যক্তিত্ব্যে তাঁর মধ্য চল্লিশের বিশাল সাংস্কৃতিক সমুদ্রের অতল নির্যাসে সিক্ত হওয়ার সৌভাগ্য তাঁকে পরিণত করেছে এক কিংবদন্তীর অসামান্য ঐন্দ্রজালিক ইতিহাসের নির্মাতারূপে। বাঙালির মানস-চেতনায় সঙ্গত কারণেই শেখ মুজিব চির বিস্ময়, চির অম্লান।