১০ মার্চ, ১৯৭১। আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। একই সঙ্গে অত্যাচার ও ষড়যন্ত্র বাড়তে থাকে। এদিন সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলখানা ভেঙে ৪০ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। জেল থেকে পালানোর সময় কারারক্ষী ও কয়েদিদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে ২৭ জন আহত হয়। অন্যদিকে সকালেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে একদল বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। এ সময় তিনি বলেন, ৭ কোটি বাঙালি আজ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। যে কোনো মূল্যে তারা এই অধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্প। তিনি আরো বলেন, এ পর্যন্ত বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার আমরা এ রক্ত দেয়ার পালা শেষ করতে চাই। তিনি বলেন, গত তেইশ বছর ধরে শোষক ও শাসক শ্রেণি বাংলাদেশকে কলোনি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আজ বাঙালিরা এসব শোষণ ও শাসনের অবসান চায়। ৭ কোটি বাঙালি আজ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়।
‘আর দেরি নয়’ এ শিরোনামে এই দিন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। অন্যদিকে ‘দ্য পিপলস’ পত্রিকায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমালোচনা করে বলা হয় ‘বাঙালির রক্তপাতের জন্য ভুট্টো দায়ী’। এই দিন লাহোরে সাবেক পিডিএম প্রধান নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের আহ্বানে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের এক সভায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য যে পূর্বশর্র্ত দিয়েছেন তার প্রতি নীতিগতভাবে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জানে ইতিহাসের রায় তাদেরই অনুক‚লে। ধ্বংসকারী যত অস্ত্রেই সুসজ্জিত থাকুক না কেন, কোনো শক্তিই আর বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না।
এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতারা বক্তৃতা করেন। পরে ডাকসু ও ছাত্রলীগ নেতাদের স্বাক্ষরিত স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি ঔপনিবেশবাদী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করার আহ্বান জানানো হয়। এই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে নিয়োজিত প্রতিটি মুক্তিসেনাকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক এই দিনও সারা দেশের সরকারি ও আধাসরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। প্রত্যেক সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি রাজারবাগ পুলিশ লাইন, থানা ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও কালো পতাকা উড়ানো হয়। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহন, পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর গাড়িতেও কালোপাতাকা লাগিয়ে রাজপথে চলতে দেখা যায়। নিউইয়র্কে বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে দেশে সামরিক সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ স্বরূপ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেও জাতিসংঘ মহাসচিবকে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারবর্গের প্রত্যাহারের যে নির্দেশ জাতিসংঘ মহাসচিব দিয়েছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিদের জীবন ও সম্পদ কতটা বিপন্ন করে তুলেছে তার প্রমাণ মেলে জাতিসংঘ মহাসচিবের এ নির্দেশে। তিনি আরো বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুধাবন করা উচিত কেবল জাতিসংঘের কর্মীদের অপসারণ করলেই এ ব্যাপারে তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কারণ, যে হুমকি আজ উদ্যত তা গণহত্যার হুমকি এবং সে হুমকি বাংলার ৭ কোটি মানুষের জন্য জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরিত মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকৃতিরই নামান্তর।
এদিকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতি প্রদান করেন। সেখানে তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। তাদের সমরসজ্জা সামনে অব্যাহত। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রতিনিয়ত সামরিক বাহিনীর লোকজন ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসা হচ্ছে। এদিন ঢাকাতে অভিনেতা গোলাম মোস্তফা ও সুরশিল্পী খান আতার নেতৃত্বে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজে’র ব্যানারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। সিভিল সার্ভিসের ২য় শ্রেণির কর্মচারীরাও এই দিন আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। এই দিন বিকালে ওয়ালীপন্থী ন্যাপের উদ্যোগে শোষণমুক্ত এলাকায় এক পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। আবার ‘লেখক-শিল্পী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদে’র ব্যানারে লেখক ও শিল্পীরা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন ১১৪নং সামরিক বিধি ঘোষণা করে।