১৯৬৭ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব ইজতেমা। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টঙ্গীর বিভিন্ন মৌজায় বিশ্ব ইজতেমার জন্য ১৬০ একর ভূমি বরাদ্দ দেন। তারই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশে ইজতেমাস্থলের রাস্তাঘাট, অসমতল ভূমি সমতলকরণ, আট হাজার ১০৬টি পাকা শৌচাগার, পাকা গোসলখানা, ওজুখানা, বিদেশি মুসল্লিদের জন্য স্থায়ী পাকা টিনশেড ঘর নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ প্রথম পর্ব অনুষ্ঠানের আগেই সমাপ্ত করা হয়।
সুদীর্ঘ সাড়ে তিন যুগ ধরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিশ্ব ইজতেমা। ২০১১ সাল থেকে একসঙ্গে এত ধর্মপ্রাণ মানুষের সংকুলান না হওয়ায় দুই পর্বে ইজতেমা চলার সিদ্ধান্ত হয়। সেই ধারাবাহিকতায়ই প্রতি বছর মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ সম্মিলন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথমদিকে ঢাকার কাকরাইল মসজিদসংলগ্ন রমনা উদ্যানের একাংশের অনুষ্ঠিত হতো এ সমাবেশ।
ইজতেমার ইতিহাস তালাশ করলে জানা যায়, বাংলাদেশে ইজতেমা অনুষ্ঠানের প্রায় ৩/৪ যুগ আগে ভারতের সাহরানপুর এলাকায় এ মহতী কাজের গোড়াপত্তন ঘটে। বর্তমান ধারায় এ তাবলিগি কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ)।
১৯২০ সালে তিনি প্রচলিত তাবলিগ আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এ কর্মপ্রয়াসকে তখন বলতেন ‘ইসালে নফস’ বা আত্মশুদ্ধির প্রাথমিক পাঠ। প্রথমত তিনি টেস্ট কেস হিসেবে ভারতের সাহরানপুর ও মেওয়াত এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি ৬টি বিশেষ গুণ অর্জনে মেহনত করার জন্য মানুষকে বলেন। সেই ৬টি বিশেষ গুণ হলো : কালেমা, নামাজ, এলেম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন (মুসলমানদের সেবা), সহিহ নিয়ত ও তাবলিগ।
যখন বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রচেষ্টা শুরু হয়, তখন এর নাম ছিল শুধুই ইজতেমা। যা অনুষ্ঠিত হতো ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। ১৯৬৪ সালে কাকরাইলে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের ইজতেমা শুরু হয়। তারপর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে এবং টঙ্গীর পাগারে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকে ধীরে ধীরে এগোতে এগোতেই আজকের টঙ্গীতে এসেছে বিশ্ব ইজতেমা। যে ইজতেমায় অংশগ্রহণ করে বিশ্বের প্রায় একশটি রাষ্ট্রের তাবলিগ প্রতিনিধিরা। শিল্পনগরী টঙ্গীতে ইজতেমা স্থানান্তরিত হয় ১৯৬৬ সালে। আর সে বছর থেকেই তাবলিগ জামাতের এই মহাসম্মিলন ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নামে খ্যাতি অর্জন করে।
মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ সম্মিলন হজে যেমন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের মুসলমানদের সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য আর ঐক্যেও প্রেরণার অভাবনীয় নজির দেখা যায়, বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমায়ও দেখা যায় মুসলিম ঐক্যের এক অপূর্ব মিলনমেলা। এর ফলে পুণ্যভূমি মক্কা-মদিনার পর তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা পরিচিতি লাভ করে বিশ্ব মুসলিমের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিলনকেন্দ্র হিসেবে। সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত এই তাবলিগ আন্দোলনকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইসলামি দাওয়াতের আন্দোলন বলা হয়ে থাকে। এই দাওয়াতের আন্দোলন ছিল শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর সারাজীবনের ধ্যান-জ্ঞান। কেননা, শেষ নবীর (সঃ) উম্মত হিসেবে উম্মতে মুহম্মদ্দির ওপর তিনি এই দাওয়তি কাজের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।
বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গিতে সরকারি জায়গা বরাদ্দ: তাবলিগ জামাত যাতে বাংলাদেশে অবাধে ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে এ উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে দাওয়াতি কাজে সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার তাবলিগি ভাই এ জামাতে সমবেত হন। বঙ্গবন্ধু টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার এই স্থানটি বরাদ্দ করেছিলেন বলেই ইজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসলমান এখানে সমবেত হয়ে দাওয়াতি কাজ পরিচালনার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
কাকরাইলে মারকাজ মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য বরাদ্দ: বর্তমানে কাকরাইলের যে মসজিদে কেন্দ্রীয়ভাবে তাবলিগ জামাতের মারকাজ অনুষ্ঠিত হয় এ মসজিদটি ছিল খুবই অপ্রশস্ত। বঙ্গবন্ধু কাকরাইলের তাবলিগ জামাতের মারকাজ মসজিদের জন্য স্থান বরাদ্দ করেন এবং মসজিদটি তারই নির্দেশে সম্প্রসারিত হয়।
রাশিয়াতে প্রথম তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা: রাশিয়া (তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন) ছিল একটি কমিউনিস্ট দেশ। সেদেশে বিদেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কেউ অনুমতি পেত না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া সহযোগিতা করায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদেশের নেতৃবৃন্দের একটি সুদৃঢ় বন্ধুত্বের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার পর প্রথম রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নে তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে তাবলিগ জামাতের যেসব দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক: আওয়ামী লীগের শিল্প বাণিজ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ কমিটির সদস্য