বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে দেশ তার নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে থাকে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দিচ্ছেন, সেই অনুযায়ী চলছে বাংলাদেশ। শুধু ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তার। একাত্তরের এই দিনে মিছিলে মিছিলে উত্তাল ছিল সারা দেশ। চরমে পৌঁছে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন।
ঢাকা শহর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। যেখানে সেখানে জটলা, মিছিল, মিটিং চলতেই থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী, দেশমাতৃকাকে শত্রæমুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সারা দেশে যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। চলে বিভিন্ন স্থানে গোপন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি।
বাংলাদেশের যুবকদের রক্তে তখন একই নেশা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ দুচোখে দেশকে হানাদারমুক্ত করার স্বপ্ন। বাঙালিদের নতুন একটি দেশ। বাঙালির হৃদয়ে শুধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন। তাই তাদের রক্তে বইতে থাকে টগবগে উত্তেজনা। শুধু অপেক্ষা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণের মাধ্যমে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের।
এদিকে সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চরমে পৌঁছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ বাংলায় তাদের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলে। পাক-সামরিক জান্তার কোনো নির্দেশ কেউই মানে না। এ জনপদের প্রতিটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। সাধারণ মানুষ অপেক্ষায়, এর পর কী হবে? তরুণ-যুবক সবাই মনেপ্রাণে প্রস্তুতি নিতে থাকে চ‚ড়ান্ত ডাকের অপেক্ষায়। অন্যদিকে যুবসমাজকে সংগঠিত করতে সারা দেশেই সংগ্রাম কমিটি গঠিত হচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা অফিসার-সৈনিকরা গোপনে নানা স্থানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বাঙালি দামাল ছেলেদের।
অগ্নিঝরা মার্চের এইদিনে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়ার জন্য মওলানা ভাসানী উদাত্ত আহবান জানান। তিনি ১৪ দফার ভিত্তিতে আন্দোলনের ডাক দেন। ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান এ অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ভাষণ দেন। বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে মওলানা ভাসানী তার চিরাচরিত দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা দেন এভাবে, হে বাঙালিরা, আপনারা মুজিবের ওপর বিশ্বাস রাখেন। তাকে খামোকা কেউ অবিশ্বাস করবেন না। কারণ, মুজিবকে আমি ভালোভাবে চিনি। সে যেটা বলে সেইটা করে ছাড়ে। মজলুম জননেতা ভাসানী পাকিস্তানের জল্লাদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে বলেন, অনেক হয়েছে আর নয়, তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। জনসভায় মাওলানা ভাসানী তুমুল করতালির মধ্যে বলেন, ‘লা-কুম দ্বিনুকুম ওয়ালিয়া দ্বিন’। অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। মুজিবের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ মার্চের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলব।
মওলানা ভাসানী এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে পূর্ণ আস্তা প্রকাশ করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বামপন্থিদের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হয়।