মার্চ কেবল পেছনে ফেলে আসা নয়-হোসেন আবদুল মান্নান


বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির জীবনে মার্চ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। মার্চ মাস যেন বাঙালির জাতিসত্তার অস্তিত্বে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে। খ্রিস্টীয় মার্চ মাস বলতে আমাদের ষড়ঋতুর বসন্তকালকেও অনুভব করি। এ সময় ঋতুবৈচিত্র্যের কারণেই বাঙালির মেজাজে-মননে, চিন্তায়-চেতনায় যেন স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন চলে আসে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, দ্রোহ-বিদ্রোহের ভাষা তার চরিত্রকে তেজোদীপ্ত ও আন্দোলিত করে তোলে। তেমনি ঐতিহাসিকভাবে বাঙালির জাতীয় চরিত্রে মার্চ মাস অসাধারণভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, মাতৃভাষার দাবি, এমনকি বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতার জীবন এবং তাঁর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে মার্চের এক নিবিড় ও অনিবার্য সম্পর্ক অন্বেষণ করা যায়।

বাঙালি জাতির বিগত এক শতাব্দীর ইতিহাসে অবিস্মরণীয়, চিরভাস্বর কিছু মার্চকে স্মরণ করা যাকÑ

১৭ মার্চ, ১৯২০ : বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়রা খাতুন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এ নেতার ৫৫ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনকালের মধ্যে প্রায় এক যুগ কাটে কারান্তরালে। পাকিস্তান সরকারের ২৩ বছরের শাসন-শোষণকালে তিনি অন্তত ১৫ বার গ্রেফতার হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। প্রকৃত অর্থে তাঁর হাত ধরেই বাঙালি জাতি পেয়েছে তার দীর্ঘ কাক্সিক্ষত স্বাধিকার। বস্তুত তাঁর নামের সঙ্গেই একাকার হয়ে আছে এ দেশের নাম। বলা হয়, বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির ইতিহাস তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হবে অনাগতকাল। এতে প্রকৃত বাঙালির কোনো সংশয় নেই। ১৭ মার্চ এখন দেশব্যাপী ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে উদ্যাপিত হয়।
২৩ মার্চ, ১৯৪০ : এদিন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ভারতীয় উপমহাদেশে একটি পৃথক মুসলিম দেশের দাবি জানিয়ে ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ অনুমোদন করে। বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সম্মেলনে পূর্ববঙ্গের বাঙালি নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ঐতিহাসিক এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এতে তৎকালীন ভারতীয় মুসলমান নেতৃবৃন্দ সমর্থন দান করেন। এর মূল বিষয় ছিল ভারতবর্ষের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রসমুহ (independent states) গঠন করতে পারবে। প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক স্বাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও সার্বভৌমত্ব অর্জনই ছিল লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য।

১১ মার্চ, ১৯৪৮ : সুদীর্ঘ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামের এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। অভ্যুদয়ের অব্যবহিত পরই বাঙালি জাতিকে সর্বপ্রথম মোকাবিলা করতে হয় নিজের মাতৃভাষার অস্তিত্ব রক্ষার এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানে সংবিধান সভায় দাঁড়িয়ে বাঙালি বীর, বাংলা ভাষার অকৃত্রিম বন্ধু অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলার পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা সেই ভাষাই হওয়া উচিত যে ভাষায় রাষ্ট্রের বেশির ভাগ মানুষ কথা বলে। সেদিক থেকে বাংলাই আমাদের রাষ্ট্রের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা।’ সে পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীন পাকিস্তানে প্রথম বাঙালি ছাত্রনেতাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের সূচনা হয় এদিন। তখন ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করা হয়। সারা দেশের ছাত্রছাত্রী বাংলা ভাষার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালের আগ পর্যন্ত এ দিবসই ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল।

১৯ মার্চ, ১৯৪৮ : পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন ছাত্রসমাজ সদ্যস্বাধীন পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা, গভর্নর জেনারেল, মুসলিম লীগ সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে প্রথমে রেসকোর্সে এবং পরে কার্জন হলের ‘কনভোকেশনে’ প্রতিবাদ করে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুখের ওপর এই প্রথম ছাত্ররা উচ্চারণ করে ‘না, না, না।  রাষ্ট্রভাষা উর্দু মানি না।’ জানা যায়, ছাত্রদের এমন সাহসিকতা দেখে সেদিন জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট মৌন হয়ে পড়ে ছিলেন। কেবল উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবেÑ জিন্নাহ তার জীবদ্দশায় পরবর্তীতে আর কখনো বলেননি। মাতৃভাষার আন্দোলনে অন্যতম প্রধান মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ওই দিনটি। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সেদিন অনেকের উপস্থিতিতে জিন্নাহর সঙ্গে তর্কে মেতেছিলেন তৎকালীন সাহসী ছাত্রনেতা মো. শামসুল হক। এতে জিন্নাহ রেগে গিয়েছিলেন।

৭ মার্চ, ১৯৭১ : বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য দিন ৭ মার্চ। এদিন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেদিন মহান মুক্তির আনন্দে উজ্জীবিত বাঙালি জাতির সামনে বঙ্গবন্ধু মুজিব বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন তাঁর অমর বাণী। ১৮ মিনিটের এ ভাষণে মুজিব রচনা করেন এক মহাকাব্য; যাতে ২৩ বছরের শত বঞ্চনার ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তিনি মেলে ধরেছিলেন তাঁর প্রিয় বাঙালির কাছে। আজ সারা বিশ্বের সর্বকালের সেরা ভাষণের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে এ ভাষণটি। ঢাকার রেসকোর্স ময়দান থেকে ঐতিহাসিক এ ভাষণ দেশের সব গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কথা থাকলেও সেদিন স্বৈরাচারী সরকার তা করতে দেয়নি। কালের পরিক্রমায় এ ভাষণ এখন অমূল্য বিশ্বসম্পদ, যা প্রচারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে বিশ্বসংস্থা জাতিসংঘ। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হয় মূলত সেদিনই। অনেকে মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচারিত ও শ্রুত ভাষণ। ২৩ মার্চ, ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এদিন দেশব্যাপী ছুটি ঘোষণা করা হয়। ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই তখন দেশ চলছিল। পাকিস্তান সরকারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রণ জনগণ মানেনি। পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে। সেদিন ‘পাকিস্তান দিবস’ থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের কোনো স্থানেই পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেনি উত্তেজিত বাঙালি জাতি।

২৫ মার্চ, ১৯৭১ : ২৫ মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। এদিন রাতেই তারা নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ঢাকার রাজারবাগ, জগন্নাথ হল, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক-জনতাকে হত্যা করে। ঢাকার রাজপথ রক্তে প্লাবিত হয়।

সেদিনের এমন নারকীয়, পাশবিক নরহত্যা পৃথিবী এর আগে আর কখনো দেখেনি। ওই রাতেই পাকিস্তানি বর্বর হায়েনার দল শত শত মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করে। গণহত্যা চালিয়ে তারা সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। বাঙালি জাতির এ ক্ষত কোনো দিন মুছে যাবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে এই কালরাতের নারকীয়তা বিশ্ববিবেককে আন্দোলিত করে যাবে। ভাবিয়ে তুলবে মানবসভ্যতাকে। নিরস্ত্র মানুষের ওপর এমন সশস্ত্র আঘাত জাতিগত যুদ্ধের ইতিহাসে অদ্যাবধি নজিরবিহীন।

২৬ মার্চ, ১৯৭১ : বাঙালির মহান স্বাধীনতা দিবস। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যদিও পরবর্তী নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান, জীবনোৎসর্গ এবং প্রায় ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি তাদের চূড়ান্ত বিজয় পায়। স্বৈরাচারী পাক সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী রাখে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলোয় রণাঙ্গনের মুক্তিসেনা ও আপামর বাঙালি জাতির সামনে সবচেয়ে বড় প্রেরণা ও শক্তির উৎস ছিলেন তাদের অবিসংবাদিত নেতা তথা জাতির ক্রান্তিকালের মহানায়ক শেখ মুজিব। শত-সহস্র দুঃখ-বেদনা, নির্যাতন, স্বজন হারানোর আর্তনাদ, সব হারানোর হাহাকারের মধ্যেও জাতি খুঁজে ফিরেছিল তাদের আপসহীন নেতাকে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা প্রাণভয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে থাকেন। প্রায় ১ কোটি বাঙালিকে ভারত সরকার আশ্রয় দেয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাক-ভারত যুদ্ধ সংঘটিত হলে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য লে. জে. নিয়াজির অধীনে থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে প্রহসনের বিচার করার পরিকল্পনা করেছিল। তারা তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার কথাও ঘোষণা করেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপে, বিশেষ করে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সর্বাত্মক উদ্যোগ ও হস্তক্ষেপের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ২৬ মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে রক্তের অক্ষরে লেখা এক গর্বিত স্মারক। এদিনই স্বাধীন বাংলাদেশ নামে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় লাল-সবুজে খচিত এক অহংকারের পতাকা।

বলা বাহুল্য, বাঙালির শত বছরের গৌরবময় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই মার্চ মাস যেন এ জাতির অহংকার আর শত অর্জনের মাস। মার্চ কখনো আনন্দের, কখনো বেদনার হলেও শেষ পর্যন্ত বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার মাহেন্দ্রক্ষণ বলতে মার্চ মাসকেই বোঝায়। জয়তু মার্চ মাস। কবির কথায়-

মার্চ এলে যুদ্ধে যাবার শপথ

মার্চ এলে অস্ত্র হাতে প্রতিবাদ

মার্চ মানে না পরাজয়-পরাভব

মার্চ মানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বজ্রপাত।

লেখক : গল্পকার, প্রাবন্ধিক।

SUMMARY

2147-1.jpg