শোক হোক শক্তি- আগস্ট মাস আসলেই এই স্লোগান ধ্বনিত হয় বাংলার আকাশে বাতাসে। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হারানোর যে শোক এই শোক বহুমাত্রিক রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। এই শোক হতে পারে মুজিব আদর্শের প্রকৃত সৈনিক হওয়ার দৃপ্ত শপথ, এই শোক হতে পারে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের অদম্য প্রত্যয়, এই শোক হতে পারে একাত্তরের পরাজিত শক্তি বধের রণত‚র্য, এই শোকের মাস হোক বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শে দীক্ষিত হওয়ার মাস।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্লোগান, যে স্লোগান গণজাগরণ সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু একটি মন্ত্র যা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করে। বঙ্গবন্ধু একটি দর্শন যা পরাধীনতার শিকলে বন্দি জাতিকে স্বাধীনতার নব প্রভায় উদ্ভাসিত করে। বঙ্গবন্ধু একটি চেতনা যা ধারণ করতে পারলে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উৎকর্ষ অবধারিত। বঙ্গবন্ধু একটি প্রেরণা যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি জোগায়।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা বলেছেন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের জনসভায় তিনি বলেছিলেন- ‘কোনো ‘ভুঁড়িওয়ালা’ এ দেশে সম্পদ লুটতে পারবে না। গরিব হবে এই রাষ্ট্র এবং এই সম্পদের মালিক, শোষকরা হবে না।’ বঙ্গবন্ধুর সেই ১৯৭২ সালের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে বঙ্গতনয়া শেখ হাসিনার ২০০৯ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে। আজ ২০১৬ সালে এসে আমাদের মাথাপিছু আয় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তথাপিও এ কথা বলতেই হবে যে, যতদিন সমগ্র বাংলার ছাত্রসমাজ বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে জাগরিত হবে না ততদিন নিখাদ অর্থনৈতিক সাম্যের সমাজ বিনির্মাণ করা যাবে না।
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমাদের অস্ত্রের সংগ্রাম শেষ হয়েছে। এবার স্বাধীনতার সংগ্রামকে দেশ গড়ার সংগ্রামে রূপান্তরিত করতে হবে। মুক্তির সংগ্রামের চেয়েও দেশ গড়ার সংগ্রাম কঠিন’। দেশ গড়ার সংগ্রাম আজো শেষ হয়নি। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও দেশবিরোধী গোষ্ঠী স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার চলমান প্রক্রিয়াকে স্তব্ধ করে দিয়ে শ্মশানাবৃত বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চায়। তারা প্রমাণ করতে চায় বাংলাদেশের জন্ম একটি ঐতিহাসিক ভুল। আজ বাংলাদেশে নব্য রাজাকারদের ক্যাঙ্গারুদৌড় স্পষ্টতই প্রতীয়মান। আর এই সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যিনি প্রাণান্ত লড়াই করে যাচ্ছেন, তিনি গণতন্ত্রের লৌহকন্যা শেখ হাসিনা। এই বিরাজমান পরিস্থিতিতে তরুণ সমাজের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া। এখানে খুব সচেতনভাবে বলে রাখা প্রয়োজন যারা ‘জয় বাংলা’র পরে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলতে দ্বিধা বোধ করেন তারা অসম্পূর্ণ বাংলাদেশকে ধারণ করেন।
আজ একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্ব নেতারা সুশাসনের কথা প্রায়শই বলে থাকেন। যা বাঙালি জাতির পিতা ১৯৭২ সালেই বলে গেছেন। সুশাসন অনেকাংশে নির্ভর করে আমলাতান্ত্রিক সুব্যবস্থাপনার উপরে। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও কট্টর আমলাতান্ত্রিক মনোভাব দুটোই সুশাসনের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে। ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সরকারি কর্মচারী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে’। যেটি এখনো সময়ের দাবি।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর নির্ভরতাকে একটি স্বাধীন দেশের জন্য লজ্জার মনে করতেন। ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল তিনি বলেছিলেন- ‘কারখানায় প্রোডাকশন না বাড়াইয়া ভিক্ষুকের জাতির কোনো ইজ্জত আছে? ভিক্ষুকের জাতির নেতৃত্ব করতে আমি চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক…’। খুবই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বংশগতির কারণে শেখ হাসিনা এই চরিত্রটি পেয়েছেন। তিনি বৈদেশিক সাহায্য প্রদানকারী মহাজনদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। তিনি তাঁর শাসনামলে মাথা উঁচু করে যতটুকু বৈদেশিক সাহায্য নেয়া যায় ততটুকু নিয়েছেন। তিনি দেশের শিরকে সমুন্নত করেছেন। এখন অসমাপ্ত কাজটুকু করতে হবে তরুণ সমাজকে। নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে, আত্মনির্ভরশীল হতে হবে, উৎপাদনশীল হতে হবে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করতে হবে। যার প্রতিটি পদক্ষেপে মূলমন্ত্র হবে বঙ্গবন্ধুর বাণী।
বর্তমান বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনৈতিক দল সরকারে আছে। সরকারি দল হিসেবে এই দলের প্রতিটি নেতাকর্মীর আচরণ কেমন হতে হবে তা বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় বলে গেছেন। ১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি বলেছিলেন- ‘সরকারের পক্ষে রাজনীতি করতে গঠনমূলক কাজের দিকে নেতাকর্মীদের এগিয়ে যেতে হবে। দেশের মানুষকে সেবা করে মন জয় করতে হবে। তোমাদের কাছে আমার নির্দেশ, তোমাদের কাছে আমার আবেদন, আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমাদের কাছে রাতের আরাম ও দিনের বিশ্রাম হারাম’। আজ থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মী যদি বঙ্গবন্ধুর এই উপদেশের ওপর শপথ গ্রহণ করে তাহলে দল হিসেবে আমাদের অবস্থান জনগণের হৃদয়ের গভীর কোণে আরো সুপ্রশস্ত হবে।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনার মানুষ গড়বেন বলে। আসুন খুব স্থির মস্তিষ্কে ভেবে দেখি আমরা নিজেরা আজ কতটুকু সোনার মানুষ হতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাঁর মূল স্বপ্ন আজো অধরা রয়ে গেছে। ১৯৭৩ সালের ৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে বেটে খাওয়ালেও বাংলা সোনার বাংলা হবে না যদি বাংলাদেশের ছেলে আপনারা সোনার বাংলার সোনার মানুষ পয়দা করতে না পারেন’। তাই একান্তই অধিকারের জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানাতে চাই- আসুন আমরা বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত সোনার মানুষ হয়ে সোনার মানুষ বিনির্মাণের চাকাকে পুনরায় সচল করি, জয় বঙ্গবন্ধু বলে এগিয়ে চলি।
২০১৩ সালে আমরা বাংলাদেশে একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পর্যবেক্ষণ করেছি এবং সাম্প্রতিক সময়ে যে জঙ্গিবাদী তৎপরতা চলছে তার পেছনের মূল কুশীলব স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও তাদের একান্ত আস্থাভাজন দোসর বিএনপি। এদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর আমাদের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন- ‘যারা ধ্বংস করে, ধ্বংসাত্মক চেষ্টা চালায়, তারা শুধু সরকারের শত্রু নয়, দেশের ও জনগণের শত্রু। তারা যে সম্পদ ও সম্পত্তি হরণ করে, ধ্বংস করে তা জনগণের সম্পত্তি।…আপনারাও এই গুপ্ত হত্যা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই’। বঙ্গবন্ধুর ওই নির্দেশনা এখনো বলবৎ আছে। তাই দেশপ্রেমিক প্রতিটি জনগণকে ওই সব দেশদ্রোহীদের প্রতিরোধে সব সময় সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
বঙ্গবন্ধু জ্ঞানার্জন ও শিক্ষাঙ্গনে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রেখে চরিত্রবান নাগরিক হতে ছাত্রসমাজকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো জাতি বড় হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু প্রত্যাশা করতেন ছাত্রসমাজ নিজেদের দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রেখে সমাজ থেকে দুর্নীতি বিতাড়নে পাঞ্জেরির ভূমিকা পালন করবে। ১৯৭৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অবস্থানের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একাত্মতা ঘোষণা করেছিল, যা বঙ্গবন্ধুকে এক শুভ্র প্রশান্তিতে ভাসিয়েছিল। এটি একদিকে যেমন বর্তমান ছাত্রসমাজের জন্য গর্বের ঠিক তেমনি অন্যদিকে একটি অনুসরণীয় উদাহরণ।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখার এই দুঃসাহসিক প্রয়াসের একবারেই শেষপ্রান্তে এসে শুধু এটুকুই বলা সমীচীন হবে যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনাকে যারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে তারা এ দেশের এক এক জন সম্পদ হিসেবে আবির্ভূত হবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই রাজনৈতিক দার্শনিকের অন্তত ৫টি গুণকে আমরা প্রত্যেকে যদি ধারণ ও চর্চা করি তাহলে একটি বঙ্গবন্ধুময় সমাজ পাব। যে সমাজ হবে বিশ্ববাসীর জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। বঙ্গবন্ধু একটি আলো, এই আলো প্রত্যেকের হৃদয়ে প্রজ্বলিত হোক, অহর্নিশ এই প্রত্যাশাই করি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।