সেই পনের আগস্টের ভোরে পুরো ধরিত্রীই থমকে গিয়েছিল, বেদনায় মুষরে পড়েছিল বিষম। বাতাস ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, আকাশ হয়ে গিয়েছিল অধিক শোকে পাথর। সৃষ্টির পর থেকে এমন শোকের ঘটনা বিশ্ব প্রকৃতি আর কখনোই বোধহয় প্রত্যক্ষ করেনি। এমন বিশ্বাসঘাতকতাও বোধহয় আর কখনোই দেখেনি। তাই পুরো বিশ্ব প্রকৃতিই হয়ে গিয়েছিল নিস্তব্ধ, শোকে মুহ্যমান পাষাণ। আর বিমূঢ়, বাকহারা হয়ে গিয়েছিল বিশ্বমানব সম্প্রদায়। যে মহান ব্যক্তি একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিল, সেই তাঁকেই তাঁরই দেশের মানুষের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে, তা বিশ্ববাসীর কাছে ছিল যেমন অবাক বিস্ময়ের, তেমনি শোকের। তাঁরা সেদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির পিতা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে কেঁদেছিলেন। কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছিলেন। অশ্রæ তাদের বাঁধ মানেনি। অক‚ল ধারায় বহমান তাদের সেই অশ্রæ বাষ্প হয়ে ধরণীর নানা প্রান্ত থেকে এসে জড়ো হয়েছিল ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের ছয়শ সাতাত্তর নম্বর বাড়ির আঙিনায়। তারপর সিঁড়িতে পড়ে থাকা মহামানবের রক্তের স্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, যাদের জন্য তিনি আজীবন মরণপণ লড়াই করে গিয়েছিলেন, যাদের সুখের জন্য, যাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজের জীবনের সব আরাম-আয়েশকে ত্যাগ করেছিলেন, জেলজুলুম-অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছিলেন, সেই তারাই তাঁর নির্মম মৃত্যুতে উচ্চস্বরে কাঁদতে পারেনি। ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গীন তাদের কাঁদতে দেয়নি, পিতা হারানোর শোক গাথা তৈরি করতে দেয়নি। কিন্তু সর্বত্রই ছিল চাপা দীর্ঘশ্বাস, চাপা কান্না। গুটিকয়েক নরপিশাচ তথা পাকিস্তানি হানাদারদের প্রেতাত্মারা ছাড়া দিকভ্রান্ত, দিশেহারা পুরো জাতি চাপা দীর্ঘশ্বাস আর চাপা কান্নার মধ্য দিয়েই তাদের পিতাকে মনে মনে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল।
সেই রাতটি ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময়, অশ্রæভেজা এক রাত। সেই রাতের কথা ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল জনপদের প্রতিটি ধূলিকণা কখনো ভুলতে পারবে না। পারা সম্ভবও নয়। রক্তের কালিতে লেখা সেই রাতের শোকগাথা বীণার করুণ সুর হয়ে বাঙালির হৃদয়ে বেজে চলে অনবরত। আমার হৃদয়ে অহর্নিশ সেই সুর বেজে চলে। ভাবিত হই মানুষের মাঝের মনুষ্যত্ব নিয়ে, অহমবোধ নিয়ে। কতটুকু নিচ প্রজাতির হলে, কত পাষাণে বাঁধানো বুক হলে এত নির্দয়ভাবে গুলি করে শিশু, গর্ভবতী নারীসহ জাতির পিতার পরিবারসহ মোট তিনটি পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করা যায়, তা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। শিউরে উঠি, চোখ জ্বালা করে ওঠে। পলাশীর যুদ্ধের প্রহসন শেষে মীরজাফরের নির্দেশে মোহাম্মদ আলী বেগ নবাব সিরাজদৌল্লাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। সেই বিশ্বাসঘাতকতা, সেই নৃশংসতা আবারো দেখল বিশ্ববাসী। সে রাতে স্ত্রী বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও দশ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল এবং ভাই শেখ নাসের ও দুজন কর্মকর্তাসহ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার চৌদ্দ বছরের কন্যা বেবী, দশ বছরের পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, চার বছর বয়সী নাতি বাবু, ভাতিজা সজীব সেরনিয়াবাত, ভাগিনা নান্টু, তিনজন অতিথি ও চারজন ভৃত্যকে হত্যা করে। সবমিলিয়ে সেই কালরাতে পঁচিশজনকে বিশ্বাসঘাতকরা হত্যা করে এ দেশের মানচিত্রকে, এ দেশের মাটিকে কলঙ্কিত করে। এ দেশের বাতাসকে দূষিত বিষবাষ্পে ছেয়ে ফেলে।
চৌদ্দ আগস্টের সন্ধ্যায় টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানবাহী শকট যানগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। আঠারোটি কামান, আঠাশটি ট্যাংক জড়ো করা হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তে। তখন চারদিকে ঘন কালো অন্ধকার। রাত সাড়ে এগারটার দিকে সেখানে জড়ো হলো মানুষ নামধারী অমানুুষ মেজর ফারুক, মেজর ডালিম, মেজর হুদা, মেজর নূর, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর রশিদ চৌধুরী। পনের আগস্টের প্রথম প্রহরে তারা তাদের অফিসারদের হেডকোয়ার্টার স্কোয়াড্রন অফিসে সমবেত হতে নির্দেশ দেয়। অফিসাররা সেখানে পৌঁছালে তাদের নিয়ে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে শেখ মুজিবুর রহমান, সেরনিয়াবাত ও শেখ মনির বাসায় আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ভোর চারটায় যখন সারা শহরবাসী গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, তখন হায়েনার দল কামান, ট্যাংক নিয়ে তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সোয়া পাঁচটার দিকে মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে প্রায় একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছিল সেরনিয়াবাত ও শেখ মনির বাসা। আর তার ঠিক মিনিট পনের বাদেই জাতির পিতার বাসায় আক্রমণ শুরু করেছিল তারা। রাষ্ট্রপতি ভবনের নিরাপত্তা বাহিনী সেই কুচক্রী সৈন্যদের দিকে অবিরাম গুলি চালিয়ে প্রাণপণ বাধা দেয়ার চেষ্টা করছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশের মানুষকে বিশ্বাস করতেন, ভালোবাসতেন। তাঁকে কেউ মারতে আসবে, এ তিনি ভাবতেই পারেননি। তাই তো তিনি পুলিশ গার্র্ডদের গোলাগুলি থামানোর নির্র্দেশ দিয়েছিলেন। আর সেই সুযোগে হায়েনার দল নির্বিঘ্নে বাড়িতে ঢুকে যায়। শুরু করে হত্যার নৃৃত্য।
বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসেরকে বাথরুমে নিয়ে গুলি করা হয়েছিল। যখন তিনি পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন, তখন ঘাতকরা অঝোর বুলেট বৃষ্টি দিয়ে তাঁকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। শিশু রাসেল বঙ্গবন্ধুর পিএস মুহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? আমি মায়ের কাছে যাব। শিশুর সেই কাকুতিতে ওদের হৃদয় গলেনি। গলবেই কী। ওরা তো হৃদয়হীন এক একটা নরকের কীট। তাই তো মাসুম বাচ্চাকেও বুলেট দিয়ে স্তব্ধ করে দিতে ওদের একটুও হাত কাঁপেনি। জাতির পিতার সঙ্গে ঘাতকদের তর্কবির্তক হয়েছিল। মেজর মহিউদ্দিনকে পিতা চড়া সুরে ধমকাচ্ছিলেন। মৃত্যুর দূূত উপস্থিত দেখেও তিনি একটুও ঘাবড়াননি, যেমন ঘাবড়াননি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও। তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে মহিউদ্দিন মিইয়ে গিয়েছিল। হুদা এসে পিতাকে ওপরের তলা থেকে নিচের তলায় নিয়ে আসে। সেখানে পড়েছিল গুলিবিদ্ধ শেখ কামালের রক্তাক্ত লাশ। হঠাৎ মেজর নূর আর মোসলেম উদ্দিন নামের দুই মোহাম্মদী বেগের স্টেনগান থেকে বের হয়ে আসা আঠারোটি বুলেটে বিদ্ধ হয়ে সিঁড়ির ধাপে গড়িয়ে পড়েন সাদা পাঞ্জাবি আর চেক লুঙ্গি পরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, আমাদের পিতা। তিনি সিঁড়িতে পড়ে রইলেন এমনভাবে যে যেন হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেছেন। পাশে পড়ে ছিল তার ভাঙা চশমা। তিনি সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, ঊনসত্তর, সত্তর এবং একাত্তরসহ বিভিন্ন সময়ে দেশের মানুষের মুক্তির জন্য মৃত্যুর দ্বার থেকে বারে বারে ফিরে এসেছিলেন। সেই তাঁকেই পাকিস্তানি হায়েনারা যা করতে পারেনি, সেটাই করল তাঁরই দেশের পাপিষ্ঠ নরাধম কয়েকজন ঘাতক। একদিন যে তর্জনি অঙ্গুলি উঁচিয়ে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর তর্জনি আঙুলটি ছিঁড়ে গিয়ে চামড়ার টুকরোর সঙ্গে ঝুলছিল। আর কোনোদিন সশরীরে ওই আঙুল উঁচিয়ে আমাদের প্রেরণা দিতে আসবেন না তিনি। ঘাতকরা সেটাই চেয়েছিল। কেবল এতেই তারা থেমে থাকেনি। বত্রিশ নম্বরের সেই বাড়ির প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে অন্য সবাইকে। চারদিকে বীভৎস দৃশ্য। রক্তের স্র্রোত বয়ে গিয়েছিল। সেই রক্তস্রোত জাতীয় পতাকার সবুজের মধ্যিখানের লাল বৃত্তে গিয়ে মিশে তাকে আরো দ্যুতিময় করে তোলে। পতাকার লাল বৃত্তের দিকে যখনই চোখ পড়ে তখনই চোখে ভেসে ওঠে রক্তস্রোতে ভেসে যাওয়া মহান নেতার সেই বাড়িটি।
জাতির পিতাকে এ দেশের আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা সেই নরকের কীটরা না চিনলেও চিনেছিলেন বিশ্বের সব রথী-মহারথীরা। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্বে, সাহসিকতাই এই মানবই হিমালয়। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের ভাষায় বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন ‘ঐশ্বরিক আগুন’ এবং তিনি নিজেই সে আগুনে ডানা যুক্ত করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল ২ মে, ১৯৭১, তার কিছু অংশ হলো এমন- ‘মার্চে শাসনতান্ত্রিক এই সংকট যখন সৃষ্টি হয় তখন শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সাধারণ বাঙালির কাছে তাঁর কাপড় স্পর্শ করা ছিল তাবিজে শুভ ফল পাওয়ার মতো। তাঁর বাক্যই হয়ে উঠেছিল আইন। ধানমন্ডিতে তাঁর বাসা থেকে তিনি সব করছিলেন, সবার সঙ্গেই ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তাঁর কাছে যাওয়ায় কোনো বাধা ছিল না। প্রতিদিন দেখা করতেন অজস্র লোকের সঙ্গে। সম্পদ বা পদমর্যাদার দিকে তাঁর কোনো নজর ছিল না, সম্পূর্ণভাবে আন্তরিক ছিলেন জনগণের প্রতি। প্রতিটি বাঙালি, তিনি যত তুচ্ছ বা গরিবই হোন না কেন, তিনি তাকে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান দিয়েই বিবেচনা করতেন, সাহায্য করতেন। তাঁর নাম তাঁর পরিবারের অবস্থা কখনো ভুলতেন না, প্রতিদানে বাঙালিরা তাঁকে বিশ্বাস করতেন, তাঁর সততা, আত্মত্যাগ, সাহস ও তাদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার বিষয়টিও বিশ্বাস করতেন।’ বঙ্গবন্ধুকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন কখনো পছন্দ করেনি। তবুও তারা কী চোখে দেখত বঙ্গবন্ধুকে তার একটি উদাহরণ ১৯৭০ সালে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেলের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো রিপোর্ট। রিপোর্টটিতে লেখা হয়েছিল- ‘মুজিব সারাজীবনই একজন রাজনীতিবিদ। ১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০ বছর তিনি কাটিয়েছেন পাকিস্তানি জেলে, যার চূড়ান্ত পরিচয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলা পূর্ব পাকিস্তানবাসীর কাছে তাঁকে মহানায়ক করে তোলে এবং তাঁর ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করে। মানুষ মুজিবকে ছাঁচে ফেলা কঠিন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি আত্মবিশ্বাসী, শান্ত, চমৎকার। বেশ ঘুরেছেন তিনি এবং শাহরিক। মঞ্চে তিনি জ্বালাময়ী বক্তা। মুষলধারায় বৃষ্টির মধ্যেও তাঁর বক্তৃতা সাধারণকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারে। দলীয় নেতা হিসেবে কঠিন এবং কর্তৃত্বপরায়ণ, অনেক সময় একগুঁয়ে। বাঙালিদের অভিযোগের কথা বলতে গেলে তিনি হয়ে পড়েন স্বতঃস্ফ‚র্ত এবং আবেগপ্রবণ। এমনকি ঘোরতর শত্রু পাকিস্তানিরাও বঙ্গবন্ধুর উচ্চকিত প্রশংসা করেছে। উদাহরণস্বরূপ স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাবেক পাকিস্তানি অফিসার মেজর জেনারেল তোজাম্মেল হোসেন মালিক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, পাকিস্তানে তাঁকে ব্যাপকভাবে দেশদ্রোহী অপবাদে চিত্রিত করা হলেও বস্তুত মুজিব দেশদ্রোহী ছিলেন না। নিজ জনগণের জন্য তিনি ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লেই বোঝা যায় তিনি আসলে কেমন ছিলেন। তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন : একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালির সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। মানুুষের প্রতি তাঁর যে অসীম মমত্ববোধ তা এই কয়টি ছত্রেই ফুটে ওঠে। অথচ তাঁকেই নির্মমভাবে আঠারোটি বুলেটে বিদ্ধ হতে হয়েছিল। যে তিনি সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই তিনিই স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকারটুকু পাননি। এর চেয়ে লজ্জা বাঙালি জাতির জন্য আর কী হতে পারে।
ইতিহাসের পাতা ঘাটলেই বোঝা যায়, কেন জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে হয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন, কার্যকরী সংবিধান প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, ওআইসির সদস্যপথ লাভ, দু’একটি রাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের স্বীকৃতি অর্জনসহ শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব খাতকে তিনি ভঙ্গুর অবস্থা থেকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। এই অগ্রগতি পাকিস্তান আর সামাজ্যবাদী আমেরিকার পছন্দ হয়নি। তাদের চক্রান্তে আর ক্ষমতালিপ্সু মেজর জিয়াউর রহমানের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা রূপে আবির্ভূত সেই ঘাতকরা নিজেদের পিতাকে অবলীলায় হত্যা করে দেশকে ওই অপশক্তির করতলে নিয়ে যায় আর দেশ নিমজ্জিত হয় অতল অন্ধকারে।
পনের আগস্টের কালরাতে ঘাতকদের সেই আঠারোটি বুলেটে বিদ্ধ জাতির পিতাই কেবল স্তব্ধ হয়ে যাননি, স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এ দেশের অগ্রযাত্রা। গভীর গিরিখাতের অতল অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল দেশের মানুষ। বিষবাষ্পে এ দেশের মানুষের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে। আবারো যেন তারা পরাধীনতার শিকলে বাঁধা পড়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সেই অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছেন। আজ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ। আজ এ দেশের মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয় না। যুদ্ধাপরাধীদের একে একে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেশ আজ অনেকটাই কলঙ্কমুক্ত হয়ে উঠছে। তবে ইদানীং স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিরা জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করছে। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে তারা। কিন্তু জাতির জনকের অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উজ্জীবিত বাঙালি তা হতে দেবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে লালন করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তারা ধিকৃত জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদী রাজনীতির শিকড় উৎপাটন করবে। বঙ্গবন্ধু এভাবেই তাঁর আদর্শ ও চেতনার মধ্য দিয়েই চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। তিনি অনশ্বর প্রতিভাস হয়ে বাংলার মানুষকে তাঁর আদর্শে বলীয়ান করে যাবেন, অনুপ্রাণিত করে যাবেন। আর মানুষ তাঁকে স্মরণ করে যাবে পরম শ্রদ্ধাভরে। এজন্যই কবি সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, ‘এই বাংলার আকাশ-বাতাস, সাগর-গিরি ও নদী/ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু, ফিরিয়া আসিতে যদি/হেরিতে এখনও মানবহৃদয়ে তোমার আসন পাতা/এখনও মানুষ স্মরিছে তোমারে, মাতা-পিতা-বোন-ভ্রাতা।’