টেবিল আলোচনায় দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের কথা হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর কথা উঠলে আমার এক সহকর্মী বললেন, কিন্তু স্যার বঙ্গবন্ধু তো নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারেননি। তাঁর কথা শুনে আমরা অনেকেই চমকে উঠলাম। তিনি কী বলতে চাইছিলেন আমরা বুঝলাম। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে শাহাদাত বরণ করাকে তিনি শেষ রক্ষা করতে পারেননি বলে অভিহীত করছেন। ইতিহাসে আছে, যখন বাংলাদেশ আন্দোলন ঘনিয়ে আসছিল এবং পাকিস্তানের সামরিক সরকার এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছিল, তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে মার্কিনি পূর্ণ সমর্থন থাকবে যদি সেইন্ট মার্টিনস দ্বীপটি দীর্ঘ সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ইজারা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন যে ফারল্যান্ড সাহেবের কাজকর্ম সম্পর্কে তিনি অবহিত আছেন এবং ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনায় গণবিরোধী সরকার ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার পেছনে তাঁর যে হাত আছে সে সম্পর্কেও বঙ্গবন্ধু অবহিত আছেন। বঙ্গবন্ধুর আপসহীন চরিত্রের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হলো বটে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের মদদে দেশীয় গণশত্রুদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন।
বীরত্বের ক্ষেত্রে, দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে, গণমানুষের কল্যাণের ক্ষেত্রে বস্তুত ‘শেষ রক্ষা করতে পারেননি’ কথাটার কোনো মূল্য নেই। একমাত্র শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আত্মরক্ষার তাগিদ থেকে এ কথাটা উচ্চারিত হতে পারে। আমার সহকর্মীর ধারণা আর বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের মধ্যে যোজন যোজন যে তফাৎ তার আলোচনা নানাভাবে করা যেতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ কবিতায় বীরত্বের চমৎকার একটি সংজ্ঞা আছে। কুন্তী কর্ণের মা হলেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁদের পরস্পর বিপরীত অবস্থান। কুন্তীর আগের ঘরের ছেলে কর্ণ, কিন্তু সেটি কর্ণ কোনোদিন জানতেন না। এদিকে কুন্তী ভাগ্য পড়ে জেনেছেন যে কর্ণ তাঁর দ্বিতীয় ঘরের ছেলেদের অন্যতম অর্থাৎ পঞ্চপাণ্ডব ভ্রাতাদের মধ্যে শীর্ষ যোদ্ধা অর্জুনের হাতে নিহত হবেন। তিনি কৌরব তথা দুর্যোধনের পক্ষ ত্যাগ করে তাঁর দ্বিতীয় ঘরের পুত্র অর্জুনদের তথা পাণ্ডবদের পক্ষ নিতে কর্ণকে প্ররোচিত করতে থাকেন। কর্ণ নিজের মাকে এ প্রথম চিনতে পারলেও বললেন, তাঁকে স্বপক্ষ ত্যাগ করতে বলা যাবে না। কারণ মৃত্যুকে ভয় পাওয়া বীরের ধর্ম নয় : ‘মাত:, করিও না ভয় / যে পক্ষ পরাজয়ের সে পক্ষ মোরে ত্যাজিতে করো না আহ্বান।’
কর্ণ-কুন্তীর সংলাপটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্যে রূপান্তরিত করেছিলেন মহাভারত থেকে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি- তে মাতা-পুত্রের মধ্যে এ ধরনের একটি সংলাপ আছে। তাঁর জ্যেষ্ঠ ছেলে (শহীদ) শাফি ইমাম রুমী, একাত্তর সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি পেয়েছেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। মা হিসেবে তারপরও জাহানারা ইমাম ছেলেকে হয়তো একবার বললেনও নিজের জীবনের উন্নতির কথা চিন্তা করতে। রুমী উত্তর দিয়েছিলেন যে আমেরিকা থেকে বড় ডিগ্রি করে কী লাভ যদি দেশ পরাধীন থাকে। ’৭১ সালের আগস্ট মাসের ২৯ তারিখ রুমীসহ ক্র্যাক প্লাটুনের আরো অনেকে ধরা পড়লেন, যাঁদের মধ্যে সঙ্গীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা বদি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের কথা চিন্তা করলে মনে হয় আমার সহকর্মীর ‘তিনি শেষ রক্ষা করতে পারেননি’ বাক্যবাণীটি যে প্রথাগত সাবধান বাণী থেকে উচ্চারিত হয়েছে, তাকে ধিক্কার জানানোই যেন তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) জীবনের দীক্ষা ছিল। তাঁর এই দীক্ষাটা ছিল বাঙালি জাতির জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র কায়েম করা। ’৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে তাঁর রাজনীতির মধ্যে মুসলিম লীগের ধর্মীয় আঙ্গিকের রাজনীতির পরিবর্তে বাঙালি ধর্মী প্রকরণটি ধরা পড়ে।
৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভায় রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে আলোচনা উঠলে কুমিল্লার সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যুক্তি তুললেন যে বাংলা যেহেতু পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা (৫৬%) সে জন্য উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। সে দাবি না মানলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ আর তমুদ্দিন মজলিস প্রতিবাদ সভার আয়োজন করল। ১১ মার্চ ১৯৪৮ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু সেদিন ছাত্রমিছিলে পুলিশ লাঠি চার্জ করলে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতা গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া পান ১৫ মার্চ, এবং ভাষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখছেন, ‘যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হলো আমরা বুঝতে পারলাম না।’ (পৃ. ৯৮)
তারপর আসছে মাতৃভাষার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অমোঘ যুক্তি : ‘দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকরা আরবি বলে। পারস্যের লোকরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারেনি। যে কোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনো কালে সহ্য করে নাই।’ (পৃ. ৯৮-৯৯)
এর পরপরই জিন্নাহর সে মহানাটকটা হলো, যখন তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতায় ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’র বিরুদ্ধে ছাত্ররা ‘না, না, না’ চিৎকার করে উঠেছিল।
বঙ্গবন্ধুর ভাষা নিয়ে যে যুক্তিপূর্ণ চিন্তা ওপরের উদ্ধৃতিতে ফুটে উঠেছে, তার গভীরতা কিন্তু পাকিস্তান একটি ধর্মীয় জাতীয়তাভিত্তিক দেশ ছিল, তার থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসবে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ থেকে এ সরলীকরণকে ছাড়িয়ে। বাংলাদেশের সৃষ্টিতে অবশ্যই ভাষার দাবিটি মৌল উপাদান, কিন্তু ঠিক ভাষার দাবির সঙ্গে বাংলাদেশের সৃষ্টি হওয়াকে তুল্যমূল্য করে দেখা ঠিক হবে না। কারণ শুধু ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ থেকে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে সেরকম বললে পৃথিবীব্যাপী রাষ্ট্রনীতির বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়। কারণ হিসেবে বললে, কেবল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ থেকে যদি রাষ্ট্র সৃষ্টি হতো তা হলে পুরো আরব বিশ্ব এক রাষ্ট্র হতো, দক্ষিণ আমেরিকার স্পানিশ ভাষাভাষী দেশগুলো একটি রাষ্ট্রে পরিণত হতো, উত্তর আমেরিকার কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র একটি দেশে পরিগণিত হতো, এমন কি বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা মিলে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল হিসেবে একটি দেশে পরিণত হওয়ার বাস্তবতা তৈরি হতো। আবার উল্টো দিক থেকে যুক্তি দিলে বহু ভাষা ও জাতি মিলে যেমন একটি দেশ হতে পারে (যেমন ভারত), তেমনি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানও একটি দেশ হিসেবে থাকতে পারত, কিন্তু থাকেনি তাঁর কারণ বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন ভাষা ছাড়াও আরো কয়েকটি বিষয়ের ভিন্নতা : সংস্কৃতি, ভূগোল এবং ইতিহাস। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ দিয়ে সংস্কৃতি, ভূগোল ও ইতিহাসের তারতম্যকে ঢেকে নিয়ে যে সুবিধাটুকু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার করে ফেলে সেটি হলো অর্থনৈতিক শোষণ। বাংলাদেশ আবির্ভূত হওয়ার প্রাক্কালে ’৭০-এর নির্বাচনের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল তার মূলে ছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ শীর্ষক পোস্টারটি, যেটি গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এবং যেটি দেখে বাঙালিী মাত্রই নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে তাকে জয়যুক্ত করে নিজেদের স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
উপরোক্ত ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বলা যায় বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশেও পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে যখন জাতি অস্থির হয়ে উঠছে, তখন বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী ভূমিকার কথা সবিশেষ স্মরণ করতে হয়, এ কারণে যে যেদিন তিনি কবি নজরুলের উচ্চারিত ‘জয় বাংলা’ শব্দদ্বয় বাঙালি জাতির পরম আরাধ্য রাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠন করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সূচনা পথে ব্যবহার করলেন, সেদিন থেকে- তখন খুবই দূরাগতভাবে, কিন্তু কালের অতিক্রমে এখন খুব নিকট থেকে- বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’ ঘোষণাটিই জঙ্গিবাদী চেতনার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবিনাশী প্রতিরোধের সংকেত হিসেবে কাজ করছে।
‘জয় বাংলা’ শব্দদ্বয় ইঙ্গিতবাহী : জয় বাংলাদেশ, জয় বাংলা ভাষা, জয় বাংলার সংস্কৃতি, জয় বাংলার শঙ্করায়ন সংস্কৃতি, জয় বাংলার কৃষ্টি, জয় বাংলার ইতিহাস ও ভূগোল, জয় বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীতের। আরো হয়তো হাজারো সংশ্লিষ্টতা আসতে পারে এ শব্দদ্বয়ের সঙ্গে। বাংলাদেশকে ধর্মীয় জাতীয়তাভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে বের করে নিয়ে আসতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে দাঁড় করিয়েছিলেন উপরোক্ত সংশ্লেষগুলোর ওপর।
সে জন্য ফারল্যান্ডের প্রলোভনকে অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করে হয়তো ‘নিজের শেষ রক্ষা’ করতে পারেননি, কিন্তু আজকের বাংলাদেশ তাঁর সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে অগ্রগতির শিখরের দিকে ক্রমশ ধাবমান। সে জন্যই তো ওই গানটা : ‘শোন একটি মুজিবুরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠধ্বনি আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি- বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’