সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর ॥
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নামই নয়, বঙ্গবন্ধু মানে একটা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। যাঁর জন্ম না হলে বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে সূর্যোদয় হতো না। শৈশব থেকেই যাঁর কণ্ঠ গর্জে উঠেছিল অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, যাঁর কণ্ঠে ছিল নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির গান, তিনিই শেখ মুজিবুর রহমান। সকল স্বাধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব ও কৈশরের নানা স্মৃতি বিজরিত মাদারীপুরের জনপদ। তাঁর শৈশবের ৪ বছরের সোনালী দিনগুলো কেটেছে এখানে। তাই মাদারীপুরের মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছিলো তাঁর নাড়ির টান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, বাংলা ১৩২৬ সনের ৩ চৈত্র মঙ্গলবার, বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মাতার নাম সাহেরা খাতুন। ছোট বেলায় শেখ মুজিবকে তাঁর পরিবারের লোকজন খোকা বলে ডাকতেন। সহপাঠীরা ডাকতো মুজিব ভাই বলে। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান সরকারি চাকুরী করতেন।
টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশবের সোনালী দিনের অনেকটা সময় কেটেছে মাদারীপুরে। সেই থেকে শেখ মুজিবের নানা স্মৃতি বিজরিত মাদারীপুরের জনপদ। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলের ৩য় শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। এর মধ্যে একবার মাদারীপুর হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে প্রথম ছাত্র জীবনে তৎকালীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলোর মত তিনিও ৮ বছর বয়স পর্যন্ত নিজ বাড়িতে পারিবারিক পরিবেশে ও গিমাডাঙ্গা প্রাইমারী স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। পরে ১৯২৯ সালে শেখ মুজিবকে গোপালগঞ্জ ‘মথুরানাথ একাডেমি’তে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। অসুস্থতার কারণে বারবার তাঁর লেখাপড়া বাধাগ্রস্থ হয়েছে।
১৯৩৩ সালে শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ মহকুমা দেওয়ানী আদালত থেকে বদলী হয়ে মাদারীপুর মহকুমা মুন্সেফ কোর্টে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন মুন্সেফ কোর্টের সেরেস্তাদার। সে সময় গোপালগঞ্জ ‘মথুরানাথ একাডেমি’তে হিন্দু ছাত্রদের দ্বারা মুসলমান ছাত্ররা নানাভাবে বাধাগ্রস্থ হতো। এ কারণে শেখ লুৎফর রহমান ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে শেখ মুজিবকে মাদারীপুর এনে ইসলামিয়া হাই স্কুলে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। মাদারীপুরে লেখাপড়া করার সময় তিনি শারীরিকভাবে মাঝে মধ্যেই অসুস্থ্য থাকতেন। এ জন্য তাঁর লেখাপড়ায়ও বিঘœ ঘটেছে। তাঁর অসুস্থতার কারণে শেখ লুৎফর রহমান স্ত্রী সাহেরা খাতুনকে মাদারীপুরে নিয়ে আসেন এবং আদি শহর বর্তমান রাস্তি ইউনিয়নের লক্ষ্মীগঞ্জে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। ইসলামিয়া হাই স্কুলে লেখাপড়া করার সময় শিশু মুজিব বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। অসুস্থতার জন্য তাঁর লেখাপড়া বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে। ১৯৩৬ সালে তিনি মাদারীপুর হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। এ সময় তিনি আবার অসুস্থ্য হয়ে পড়েন এবং তাঁর চোখে গ্লুকোমা রোগ ধরা পড়ে। ডাক্তারের পরামর্শে তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতা নিয়ে যান। চিকিৎসার শেষে তিনি তার পিতার সাথে পুনরায় মাদারীপুর ফিরে আসেন। এসময় তিনি মাদারীপুরে এসে খেলা-ধুলা ও বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের সভা-সমাবেশে তাঁর পূর্বসূরিদের সান্নিধ্যে আসেন। মাদারীপুরে তখন স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার বইছে। কৈশরে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ছিল তাঁর উঠাবসা। কলকাতা থেকে ফিরে চোখের কারণে তাকে এক বৎসর বিশ্রাম নিতে হয়। যে কারণে ৫ম শ্রেণিতে ১৯৩৬ সালে তিনি লেখাপড়া করতে পারেননি। এ অবসর সময়টা তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ও সভা-সমাবেশে যোগদান করে তাদের নজরে আসেন। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি মাদারীপুর-গোপালগঞ্জ যাতায়াত করতেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুর থেকে বদলী হয়ে গোপালগঞ্জ চলে যান। ১৯৩৬ সালে কিশোর মুজিবকে গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুলে ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাথে মাদারীপুরের ঘনিষ্ঠতার আরো এক কারণ হল পারিবারিক ও বৈবাহিক সূত্র। বঙ্গবন্ধুর বড় বোন শেখ ফাতেমা বেগমের বিয়ে হয় শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামের নুরুদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরীর সাথে। সেই সূত্রে ইলিয়াস আহাম্মেদ চৌধুরী দাদাভাই বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ছিলেন। দাদাভাইয়ের বড় ছেলে বঙ্গবন্ধুর নাতি মাদারীপুর-১ আসনের এম.পি নুর-ই-আলম লিটন চৌধুরী এবং আর এক নাতি মজিবর রহমান নিক্সন ফরিদপুর-৪ আসনের এম.পি। বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ফুফু রহিমা খাতুনের বিয়ে হয় মাদারীপুর শহরের মৌলভি হাফিজউদ্দিনের সাথে। তার ছেলে মহিউদ্দিন আহম্মেদ রাজা মিয়া। রাজা মিয়ার বড় ছেলে এ.এইচ.এম নিজামউদ্দিন হামিম ছিলেন একটি বেসরকারী ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট, দ্বিতীয় ছেলে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাছিম এম.পি, দুই ছেলে জালালউদ্দিন ইয়ামিন বিশিষ্ট ও শফিউল আলম মুরাদ ব্যবসায়ী, এক ছেলে খালিদ হোসেন ইয়াদ মাদারীপুর জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র এবং ছোট ছেলে মো. সাইফুল্লাহ ওয়ালিদ সেনাবাহিনীর মেজর। এসব পারিবরিক আত্মীয়তার কারণে মাদারীপুরের সাথে বঙ্গবন্ধুর রয়েছে নাড়ির সম্পর্ক।
বঙ্গবন্ধু মাদারীপুরে অবস্থান কালে অবসর সময়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশে মিছিল মিটিংয়ে ও খোলা-ধুলা করে দিন কাটাতেন। স্কুল জীবন থেকেই নেতৃত্ব দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা শক্তি ছিল তাঁর ভেতরে। হয়তো এ কারণে তিনি খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার স্থপতি অতঃপর জাতির পিতা হতে পেরেছেন। মাদারীপুরে লেখাপড়া করার সময় বঙ্গবন্ধু ফুটবল খেলায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে ফুটবল টিম গঠন করেছিলেন। ঐ ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। মৌসুমে ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অর্জন করেছেন বহু শিল্ড, কাপ ও মেডেল। খেলাধুলার নেতৃত্ব দানের জন্য কিশোর মুজিবের খ্যাতি ছড়িয়ে পরে অত্র অঞ্চলে।
স্কুলে লেখাপড়া করার সময় অন্যায় ও অনিয়মের প্রতিবাদ করে তিনি ছোট থেকেই সাহসী হয়ে উঠেন। পরিদর্শকরা স্কুল পরিদর্শনে এসে তার বাচনভঙ্গি প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ও সাহস দেখে অবাক হয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধু মাদারীপুরে থাকাকালীন পাঁচখোলা গ্রামের গগণ বেপারী নামে এক ব্যক্তির কাছে সাঁতার শিখতেন। সেই গগণ বেপারী এখন আর বেঁচে নেইÑবেঁচে নেই তার ফুটবল দলের কোন খেলোয়ার। ১৯৫০ সালে মাদারীপুর হাই স্কুল ও মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুল একীভূত করে ইউনাইটেড ইসলামিয়া হাই স্কুল নামকরণ করা হয়। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হয়ে যখন মাদারীপুরে আসেন, তখন দীর্ঘদিন সাঁতার শেখানো সেই গগণ বেপারীকে চিনতে পেরে তিনি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।
মাদারীপুর থেকে চলে যাওয়ার পরেও তিনি বহুবার গোপালগঞ্জ মাদারীপুর যাতায়াত করতেন। তিনি যখন রাজনীতির মাঠে অবিসংবাদিত নেতা এবং বিশ্বে যখন তার পরিচিতি আকাশ চুম্বি তখনও তিনি মাদারীপুরে এসেছেন। বহু সভা-সমাবেশে ভাষণ দিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করেছেন।
স্বাধীনতা অর্জনের পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার মাত্র মাদারীপুরে এসেছিলেন ১৯৭৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। তিনি ঐদিন দুপুরে হেলিকপ্টারে এসে মাদারীপুর পুলিশ লাইন মাঠে নামেন। সেখান থেকে লেকেরপাড় সড়ক বিভাগের ডাকবাংলোতে ওঠেন। সেখানে বিশ্রাম নিয়ে সামান্য কিছু খাবার খেয়ে সরাসরি চলে যান মাদারীপুর পাবলিক স্কুলের সামনে। ঐখানে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সেখানে অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ভাষণ দেন। সমাবেশ শেষে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে ৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিকেল সাড়ে ৩টায় এ.আর হাওলাদার জুট মিল মাঠের জনসভায় ভাষণ দিয়ে বিকেল সাড়ে ৪ টায় হেলিকপ্টারযোগে মাদারীপুর ত্যাগ করেন। এটাই ছিল মাদারীপুরের মাটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ পদার্পণ।
মাদারীপুরের সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর মমত্ববোধ ও শত স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও এখানে শুধু একটি বঙ্গবন্ধু ‘ল’ কলেজ ছাড়া তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার মতো আর কিছুই নেই। এমন কি তিনি যে স্কুলে লেখাপড়া করতেন সেই স্কুলটি ইউনাইটেড ইসলামিয়া হাই স্কুল নামে নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু আজো এই স্কুলে জাতির পিতার কোন স্মৃতি নেই।