ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন :
আজীবন সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনার উৎস সন্ধান করতে হবে তার বিভিন্ন সময়ের উচ্চারণে ও স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে গৃহীত শিক্ষা-সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্যোগের গভীরে। এ সম্পর্কে লিখিত কোনো বিষয়-ঘনিষ্ঠ দলিল নেই। কারণ, বঙ্গবন্ধুর জীবন কেটেছে সংগ্রামে আর সংগ্রামী উচ্চারণে, কারার অন্তরালে বা রাজপথে সংগ্রামী জনতার নেতৃত্বে। সুতরাং তার চিন্তা- ভাবনার বিশাল-বিচিত্র জগতের পরিচয় মেলে অসংখ্য ভাষণ, বক্তব্য, বিবৃতি এবং আলাপচারিতায়। এমনই সব তথ্য-উৎস থেকে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা সম্পর্কে যে ধারণা সৃষ্টি হয় তার অন্তত দুটো বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। এক. উপযোগী শিক্ষাকে তিনি বাঙালিত্বকে সমৃদ্ধ করা এবং তার যথাযথ বিকাশের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতেন। প্রসঙ্গক্রমে স্মর্তব্য,তার সেই অসামান্য কাব্যিক উক্তি: ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’। দুই. সর্বজনীন শিক্ষাকে তিনি মানব-সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ মনে করতেন।
শিক্ষাভাবনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক দিকনির্দেশক বক্তব্য পাওয়া যায় ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের সময়ে দেওয়া বেতার-টেলিভিশন ভাষণে। এই ভাষণে তিনি তিনটি স্পষ্ট প্রস্তাব রেখেছিলেন। প্রথমত, সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিযোগ আর কিছু হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্যে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। তৃতীয়ত, দারিদ্র্য যেন উচ্চশিক্ষার জন্যে মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এই তিনটি প্রস্তাবের নিহিতার্থ বিশ্লেষণ করলে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-ভাবনার দুটো লক্ষ্য নির্দেশ করা যায়। এক. সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে শিক্ষাকে সর্বোত্তম বিনিয়োগ খাত হিসেবে চিহ্নিত করা। দুই. দরিদ্র কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থী যেন শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় ।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মতো স্বল্পশিক্ষিত এবং সম্পদ-দরিদ্র দেশে শিক্ষাখাতকে এমন দুটো লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যুক্তিসঙ্গত। অর্থাৎ বলা যায় যে, বাঙালির শিক্ষা-অবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ছিলো বাস্তব ও কল্যাণমুখি। বঙ্গবন্ধু তার সারাটি সংগ্রামী জীবনে বাঙালির শিক্ষা উন্নয়ন নিয়ে যা ভেবেছিলেন তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটে ১৯৭২-এ প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদে সরকারের জন্যে তিনটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো; যেমন- ক.একই পদ্ধতিতে গণমুখি ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য, খ.সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, গ.আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
একটি দরিদ্র ও সদ্য স্বাধীন দেশর জন্য এমন শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো বিকল্প ভাবা যায় নয়। অবশ্য স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিতে যে ব্যাপক উদ্যোগের মাধ্যমে এ লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন করা যায় তা সঙ্গত কারণেই গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তবুও বাংলাদেশের শিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজানোর জন্যে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. কুদরাত-এ- খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। ২৪ সেপ্টম্বর এই কমিশন উদ্বোধন কালে বঙ্গবন্ধু পুনর্গঠিত শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন: ‘জনগনের বাঞ্ছিত সমাজতান্ত্রিক সমাজ।’ উপরন্তু, তিনি বাংলাদেশের সম্পদ সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় রেখে এমন এক দীর্ঘমেয়াদী রূপরেখা প্রণয়নের জন্যে শিক্ষা কমিশনকে আহ্বান জানান যা শিক্ষাক্ষেত্রে ‘সার্থক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার সাধনে সাহায্য করবে।’ ১৯৭৪ সালের ৩০ মে শিক্ষা কমিশন চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছিলো, ‘শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির আশা-আকাক্সক্ষা রূপায়নের ও ভবিষ্যৎ সমাজ নির্মাণের হাতিয়ায়। দেশের সকল শ্রেণির জনগণের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের উপলব্ধি জাগানো, নানাবিধ সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা অর্জন এবং তাদের বাঞ্ছিত নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির প্রেরণা সঞ্চার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান দায়িত্ব ও লক্ষ্য। তদুপরি শিক্ষার সর্বস্তরে জাতীয় মূলনীতি চতুষ্টয়ের সার্থক প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার মূলনীতির সঙ্গে আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত জাতীয় নীতিমালা চতুষ্টয়ের যোগসাধন করে বাংলাদেশের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যবলী নিম্নরূপে নির্ধারণ করা যায় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, দেশপ্রেম ও সুনাগরিকত্ব, মানবতা ও বিশ্বনাগরিকত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়ার রুপে শিক্ষা, প্রয়োগমুখি অগ্রগতির অনুকূলে শিক্ষা, কায়িক শ্রমের মর্যাদা দান, নেতৃত্ব ও সংগঠনের গুণাবলী, সৃজনশীলতা ও গবেষণা এবং সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক প্রগতির ক্ষেত্রে শিক্ষা।
শিক্ষা কমিশনের সুপারিশসমূহ বিশ্লেষণ করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, প্রস্তাবিত শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের মানবিক জীবন নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষাকে সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবেও নির্ধারণ করা হয়েছিলো। অর্থাৎ সামগ্রিক অর্থে স্বাধীনতাকে মুক্তির পর্যায়ে উন্নীত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ ছিলো এই প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থা। উল্লেখ্য, ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে স্বাধীনতার আগে মুক্তির কথা উচ্চ্রাণ করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনাতার সংগ্রাম।’ অর্থাৎ স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাঙালির সামগ্রিক মুক্তিকেই বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু কুদরাত-এ খুদা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের সময় বঙ্গবন্ধু পাননি। তবুও তার জীবদ্দশায় শিক্ষা সংক্রান্ত গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিলো দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, এগারো হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন; এবং শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ। অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিলো, ’৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইন, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হয়েছিলো। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু সঙ্গত কারণে উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রাথমিক শিক্ষাই শিক্ষার মূল ভিত্তি; এবং যার জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত অবকাঠামো ও যোগ্য শিক্ষক। মেধাবী শিক্ষকদের আকর্ষণ করার জন্য তাদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করেন।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-ভাবনার প্রতিফলন কুদরাত-এ-খুদা কমিশেনের রিপোর্টে প্রতিফলিত হয়েছিলো। একই সঙ্গে এটাও বলা চলে যে, ’৭২-এর সংবিধানে শিক্ষা সক্রান্ত ধারার মৌল চেতনাও প্রতিফলিত হয়েছিলো। কিন্তু এই রিপোর্ট বাস্তবায়িত না হওয়ায় স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-ভাবনার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন সম্ভব হয়নি। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, স্বল্প সময়ের মধ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মাধ্যমে এই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আংশিকভাবে সূচিত হয়েছিলো।
লেখক : বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি)