শেখ রাশেদুজ্জামান রাকিব
যুদ্ধপ্রান্ত থেকে সদ্য ফেরা ক্লান্ত, শত্রু শঙ্কাহীন বিজয়োল্লাসী সৈনিক প্রশান্তির মোহে ও অন্বেষণে যেই না একটু বাংলার শীতল মৃত্তিকায় দীর্ঘ কায়া উজাড় করে গভীর নিদ্রায় মগ্ন ; ঠিক সেই ক্ষণে বিশ্বাসঘাতকের নিদ্রাহীন শকুনি চোখ তাকে নির্মূল করার মহাযজ্ঞ আয়োজনের ঘৃণ্য প্রচেষ্টায় মেতেছিল তা কে জানতো। ১৫ আগস্টে তাকে চিরতরে মস্নান করার মধ্য দিয়ে বাংলার আকাশে যে শোকগাঁথা স্থাপিত হয়েছে তা ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ে চির দৃষ্টান্ত হয়ে রবে। অথচ এ তেজস্বী ও মহান ব্যক্তিত্বের উদয় হয়েছিল কুচক্রী শাসকদের ভীত কাঁপিয়ে দিতে। ধূমকেতুর মতো তার আবির্ভাব অতি বিস্ময়ের উদ্রেক করে। কেননা, এ দেশের মানুষের স্বাধীন সত্ত্বা বলে কিছু ছিল না।
দীর্ঘকাল অন্যের অধীনস্থতায় শোষিত হয়ে যখন বাংলার মানুষ পর্যুদস্তের চূড়ান্ত সীমানায় উপবিষ্ট ঠিক তখনই এ দেশের ভাগ্যাকাশে দীপ্তিমান সূর্যের অভ্যুদয়ের মতো একজন মুজিবের আবির্ভাব ঘটেছে যে কি-না তার আদর্শ সংগ্রামী জীবনের প্রতিদান স্বরূপ এ দেশের মানুষের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর অলংকারে আখ্যায়িত হয়েছে। তার সমগ্র জীবনে যে সংগ্রামী মহিমা ও চেতনার চর্চা ছিল তার উন্মেষ খুব অঙ্কুরেই ঘটেছিল। স্কুলের ছাত্র অবস্থায় তার নামে প্রথম মামলা হয় এবং তিনি প্রথম জেল জীবনের সাক্ষাৎ লাভ ও স্বাদ আস্বাদন করেন ১৯৩৮ সালে। ঐ সময়েই সরকার বিরোধী দলীয় প্রধানমন্ত্রীর (বর্তমান উপমন্ত্রী) তার স্কুলে আগমন উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হলে সরকারের রোষাণলে পড়ে এক হত্যা মামলার আসামি হন। সংগ্রামের পাশাপাশি জীবনের প্রথমার্ধেই এ দেশের পীড়িত ও অসহায় মানুষের জন্য দরদবোধ উপলব্ধি করেছিলো যা ক্রমান্বয়ে গভীর হতে গভীরতর হয়েছে। কিশোর মুজিবকে আমরা অন্যের কল্যাণার্থে ঝাঁপিয়ে পড়ার এক মহান চরিত্রে আবিষ্কার করি। অন্যের কষ্ট প্রত্যক্ষ করে নিজের ছাতা অকাতরে সঁপে দেবার দৃষ্টান্ত যেনো তাকে সাধারণ মুজিব হতে বঙ্গবন্ধু হবার হাতছানি দিয়েছিল। জালিম শাসকদের কর্মকা-ে কৈশোরেই মনে মনে বিরুদ্ধতার ছবি এঁকেছিলেন। হয়তো সেই ক্ষণেই তার উপলব্ধি হয়েছিল এ দেশের মানুষকে অন্যের অধীনস্থ হতে পরিত্রাণের কা-ারি হিসেবেই তার আবির্ভাব হয়েছে। বাংলার মুক্তির হাল তাকেই ধরতে হবে এবং মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতার তৃষ্ণার পরিতৃপ্তির জন্য সংগ্রামী জীবনযাত্রার পথে ধাবিত হতে হবে।
সেই সূত্রে যৌবনের পাক্কালেই কুচক্রী শাসকদের অন্যায় ও নির্যাতনমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ অবস্থান নেন, যুবকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হন। স্বল্প সময়ের পরিক্রমায় রাজনীতিতে রাজসিক স্থান দখল করতে সমর্থ হন নিজ মেধা,পরিশ্রম ও যোগ্যতার বলে। তার মননে ক্রমান্বয়ে জন্মভূমি ভক্তির স্ফুরণ ঘটে, বিদ্রোহী ও তেজস্বী চেতনা লাভ করেন নির্যাতিত শাসকদের প্রতিমূর্তি দেখে। সেই সঞ্চিত চেতনাকে দৃঢ়করণ ও সার্বজনীন আকাঙ্ক্ষার রূপদানের লক্ষ্যে তরুণদের নিয়ে গড়ে তোলেন বিপ্লবী অথচ সুস্থ ধারার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সংগঠন ছাত্রলীগ।
এরপর ভাষা আন্দোলনের জন্য গড়ে তোলেন ্তুরাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ্থ। খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে ঘোষণা দেবার ক্ষণকাল পরেই যুবক মুজিবের নেতৃত্বে এ দেশের ছাত্রসমাজ বিরুদ্ধ অবস্থান নেয়। কিন্তু এর পরিণতি স্বরূপ তাকে জেলে যেতে হয়। এই জেল জীবনের উন্মেষকালের পর আর কখনো তার জীবনে ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চিন্তার ফুসরত আসেনি। ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলে তার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয় এবং দেশদ্রোহীতার মিথ্যা অপবাদ দিয়ে জেলে রাখা হয়। কিন্তু এসব কিছুই তার স্বাধীন চেতনাকে টলাতে পারেনি। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয় মাতৃভাষার সংগ্রামের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে জেলে বসেও অনশন শুরু করেন। এই একজন তরুণ সম্ভাবনাময়ী যুবক, যার পরিবার ছিল, ব্যক্তিগত জীবন ছিল, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। কিন্তু দেশমাতৃকার তরে সব কিছুকেই জলাঞ্জলি দিলেন।
সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় তার জেল জীবন ও তার প্রতি জুলুম, নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধাচারের জন্য তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অপবাদ দিয়ে মামলা করা হয়। ফলে অন্য একটি মামলায় ১৪ মাস পর জেল থেকে মুক্তি লাভের পরেই জেল গেটেই আবার তাকে আটক করা হয়। এ থেকে সহজেই অনুমেয় তার সংগ্রামী জীবন কতটা কণ্টকাকীর্ণ ছিল, জীবনের পদে পদে জেল-জুলুম-নিগ্রহ তাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে কিন্তু তিনি এ দেশের সাধারণ মানুষের নির্যাতনের দৃশ্য অবলোকন করে আবার হামাগুড়ি দিয়ে জেগে উঠেছেন।
১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্তদের মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানালে তাকে জননিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়। বস্তুত এসব ভুয়া মামলা ছিল ধূর্ত শাসকদের কলাকৌশল মাত্র। কেননা তাদের শঙ্কা ছিল যে বটবৃক্ষ বাংলার ভূমিতে উদয় হয়েছে তাকে বিনাশ করতে না পারলে তাদের ধস অনিবার্য। মূলত জাতির জনকের প্রতি তাদের এ দর্শন ছিল। অর্থাৎ তারাও বঙ্গবন্ধুকে বটবৃক্ষ মনে করতো যার মমতার ছায়ায় এ দেশের সাত কোটি প্রাণ আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি সময়ের পরিক্রমায় একেকটি সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনের নিমিত্তে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তার এ প্রচেষ্টাকে হুমকি হিসেবে নিয়েছিলো দুরদর্শী জালিম শাসকেরা। তাই তার সংগ্রামী চেতনাকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয় তারা নানা কলাকৌশল অবলম্বন করে। বারবার তাকে কারার চার দেয়ালে আবদ্ধ রেখেছে তারা। কিন্তু তবুও এ মহান ব্যক্তিত্বের শির সদা চির উন্নত ছিল সংগ্রামের জন্য। এ সংগ্রামের পাক্কালেই আবার বন্দি হন ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারিতে জননিরাপত্তার ভুয়া অপবাদে। এরপর ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ এনে মতাকে রাজবন্দি করা হয়। শুধুমাত্র ১৯৬৫ সালের প্রথম তিন মাসেই ৮ বার গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। এ থেকে সহজে অনুমেয় যে, তার এ জীবন কতটা সংঘাত ও অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। কারাভোগের এ দিনগুলোতে তার পরিবারের সাথে সম্পৃক্ততার এতটাই ছেদ ঘটেছে যে একসময় তার সন্তানেরা তাকে বাবা বলতে ভুলে গেছে। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে তার কণ্ঠেই তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে 'রাসেল একসময় ওর মাকে বাবা ডাকতে শুরু করে, কারণ আমাকে ও খুব কম দেখতে পেয়েছে'। তার বাবার কাছে লেখা চিঠিতে মুজিব লিখেছেন বাবা, যে দেশের মানুষের জন্য পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি নিরলস সংগ্রামে লিপ্ত, তারাও বিশ্বাস করে যে আমি দোষী। জীবনে এর চেয়ে বড় বেদনা কী থাকতে পারে! তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার কারা হতে মুক্তি পেলে কিছু একটা কাজ করে পরিবার নিয়ে বসবাস করেই জীবনটা অতিবাহিত করে দিবো। 'যে মুজিব দুঃখে এ কথা ব্যক্ত করেও জেল হতে বের হয়েই আবার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন সেই তো ্তুবঙ্গবন্ধু্থ উপাধিতে ভূষিত হবার সুযোগ্য নেতা। বস্তুত সমগ্র বাংলা ছিল তার পরিবার। তাই তিনি এ চেতনা অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি হন। ১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর শহিদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার নামকরণ করেন বাংলাদেশ। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে বলেন বাংলার সংস্কৃতিতে বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর নামেই বাংলা শব্দের সম্পৃক্ততা নেই। তাই তিনি এ নামকরণ করেন। ১৯৭০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের লায়ালপুর সামরিক জেলে তার মৃত্যুর অপচেষ্টা চালানো হয়। তবুও তার কণ্ঠে সংগ্রামী চেতনা উজ্জীবিত ছিল। নির্ভয়ে বলেছেন মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না, কেননা আমি বাঙালি।
এভাবে প্রতি মুর্হূতে তার জীবন নানা পরিক্রমায় বিভক্তি ঘটে। শুরু হয় জেলজীবন, পতিত হয় শকুনিদের আক্রোশের মুখে। তার ক্ষণকালীন রাজনৈতিক জীবনে এতবার কারাভোগ করতে হয়েছে তা বিশ্বের অন্য কোনো বিপ্লবী নেতাদের ললাটে জোটেনি। মাত্র ২৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ১৮ বার জেলে গিয়ে ১১ বছর কারাভোগ করেছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন ২ বার। আর বাকি সময় জালিম শাসকদের কঠোর নজরদারিতে কাটিয়েছেন। কিন্তু তবুও জন্মভূমির ও এ দেশের নিরীহ মানুষের মুক্তিই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। তার নিজের ভাষাতেই তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে ্ত 'কোনো জেল-জুলুমই কোনোদিন আমাকে টলাতে পারেনি, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা আমাকে বিব্রত করে তুলেছে'। কতটা আবেগময়ী কথা তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। মূলত দেশ ও মানবের জন্য এ মমত্ববোধ ও প্রীতির ধারালো কাস্তেই তাকে নির্ঘুম থাকতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে দিনের পর দিন। ফুলশয্যা তার জন্য কণ্টকময় বোধ হয়েছিল। জন্মভূমির প্রতি মায়া এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লবী চেতনার জন্য তিনি সারা বিশ্বে তরুণদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা বাঙালির জায়গায় আসীন হয়েছেন। দেশ ও মাটি তাকে এতটা সম্পৃক্ত করেছিলো যে, পাককারাগারে মৃত্যুর প্রতীক্ষার পাক্কালেও নির্ভিকচিত্তে বাংলার জয়গান গেয়েছেন; এ দেশের মানুষের মুক্তির জোরাল আবেদনের কণ্ঠ উত্থিত করেছেন। দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে বলবো -আমি বাঙালি, বাঙলা আমার একমাত্র পরিচয়। অলিক ও ভ্রান্তির সাথে তিনি আজীবন আপোসহীন অবস্থায় ছিলেন। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যা সত্য তাই সুন্দর, আর সত্যের জয় অবধারিত। সেই যে তরুণ বয়সে দেশের মুক্তির মহান ব্রত কাঁধে নিয়েছেন তা আজীবন তাকে জুলুম-নিগ্রহ ও নির্যাতনের মুখে পতিত করেছে; কিন্তু তবুও তিনি উৎকণ্ঠিত ছিলেন না। তারই নেতৃত্বে চুয়ান্নর নির্বাচন, বাষট্টির আন্দোলন, ছেষট্টির ছয়দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও চূড়ান্ত পর্যায়ে সত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয় এ দেশের আকাশে। এ সংগ্রামের প্রাক্কালে নিজের পরিবার ও সন্তানদের স্নেহ হতে বঞ্চিত করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সাদামাটা মানুষ ছিলেন তিনি। তার নিজের কথায় তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে-'আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না, এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই কী আর মৃত্যুদিনই কী'। বিত্তের প্রতি কতটা নির্মোহ ও অসম্পৃক্তার উদাসীনতার জন্য এ কথা অবলীলায় উচ্চারণ করেছেন তা অনাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্য অনুকরণীয়। তার দৃঢ়চেতা বলিষ্ঠ দেহে ও বজ্র কণ্ঠে ৭ই মার্চের যে ভাষণ রেখে গেছেন তা বিশ্বের অন্যতম বাগ্মিতার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এবং আমাদের তরুণদের জন্য তা বিপ্লবী সংগীত। 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' এ তেজস্বী ও মুক্তিকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাণী একমাত্র তার কণ্ঠেই নির্ভিকভাবে ধ্বনিত হয়েছে পরাশক্তিকে উপেক্ষা করে।
তার দৃঢ়চেতা মানসিকতা ও দীর্ঘকায়ায় বিমুগ্ধ ফিদেল কাস্ত্রো অকুণ্ঠচিত্তে বলেছেন,'আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। 'হিমালয়ের দৃঢ় অবস্থানের সাথে সাদৃশ্য স্বরূপ কাস্ত্রোএ উক্তি করেছে। বহির্বিশ্বে তার ভাবমূর্তি এতটা ইতিবাচক ছিল যে, আন্তর্জাতিক মিথস্ক্রিয়ার প্রতি তিনি উদারচেতা ও শান্তিকামী ছিলেন। এ জন্য স্বাধীনতাত্তোর তিনি অবিলম্বে ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'সকলের সাথে বন্ধুত্ব করো, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়'।
তার উক্তি থেকেই অনুমেয় যে, বহির্বিশ্বের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি কতটা গৌরবময় ও উন্নয়নকামী ছিল। মূলত তিনি তার কর্ম ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের জন্য দেশ-কাল ছাপিয়ে সব দেশের সব কালের অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় মহান পুরুষে পরিণত হয়েছেন। কেননা, দেশ ও দেশের মানুষই ছিল তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের একমাত্র ভাবনার জায়গা। মোহের শক্তিকে তিনি পরাস্ত করেছিলেন এ ভাবনার শানিত তরবারি দ্বারা। লোভের বশবর্তী হয়ে মাতৃভূমিকে অন্যের কাছে বিক্রি করার কুপ্রস্তাব তিনি অনেক পেয়েছিলেন। কিন্তু বলিষ্ঠ কণ্ঠে ও পদতলে পিস্ট করেছিলেন সেসব প্রস্তাব।
আবার স্বাধীনতা লাভের পর ও তার সংগ্রাম অব্যাহত ছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর দেশের পুনর্গঠনের জন্য। তিনি দেশের সাত কোটি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেবার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু এ সংগ্রাম সাফল্যম-িত হবার আগেই কিছু দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকের রোষের কবলে পতিত হন, ১৯৭১ এর ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় তাকে। সেদিন বাংলার আকাশ -বাতাস শোকে ভারী হয়ে গিয়েছিল। সব কিছুতে মৌনতা বিরাজ করছিলো।
কিন্তু তার দেহের বিনাশ ঘটলেও আত্মিকভাবে দেশের সব মানুষের অন্তরে বেঁচে আছেন তিনি। বেঁচে আছে তার সংগ্রামী চেতনা ও স্বপ্নগুলোও। তার সেই সংগ্রামী নীতি নিয়েই তার অনুসারীরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই প্রচেষ্টা অনেকটাই সফলকাম হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে অশ্বের গতিতে এগিয়ে যাওয়া এ দেশ আন্তর্জাতিক পরিম-লে অনেক দেশের জন্য উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত এ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ও বিশ্বের শান্তির আকাঙ্ক্ষা তারই ছিল। এ জন্যই তিনি সব কালের সব দেশের যুবকদের কাছে, চির তারুণ্যের প্রতীক হয়ে আছেন। কিন্তু তার এ অবদানকে অস্বীকার কিরে কিছু বিশ্বাসঘাতক তার অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাকে বিতর্কের ইস্যু করছে প্রতি নিয়ত। কিন্তু এ কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, তিনি ছিলেন বাংলার স্থপতি, বাঙালির অহংকার ; তর্কের ইস্যু নয়।
শেখ রাশেদুজ্জামান রাকিব : কলামিস্ট