বঙ্গবন্ধুর টুকরো স্মৃতি-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

।। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ।।
বাংলাদেশ নামক রাষ্টের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাতারাতি বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি তিনি। হঠাৎ জাতির পিতাও হননি। এর পেছনে রয়েছে তার সুদীর্ঘ সংগ্রাম, কারাভোগ, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জনগণের জন্য জীবনের ঝুঁকি গ্রহণ। স্বাধীনতার পর এক বিদেশি সাংবাদিককে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সবলতা (strength) হলো, আমি মানুষকে ভালোবাসি। আর দুর্বলতা (weakness) হলো, আমি মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ জনগণকে ভালোবেসে তাদের মুক্ত করার সংকল্পের জন্যই তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান ‘আসামি’ হয়েছিলেন। লাখো মানুষের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে ওই মামলা বানচাল হয়ে যায়। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দিয়ে ‘জনগণকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’ বলার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি জনগণের মধ্যেই ছিলেন। পালিয়ে যাননি, আন্ডারগ্রাউন্ডেও যাননি। দুরন্ত সাহসী এই মানুষটি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে উন্নত শিরে ধরা দিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। গোপন বিচার করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করল। কারাগারে খনন করা কবরের পাশে কারাকক্ষে বসে তিনি মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ভালোবাসার জয়গান গাইলেন। কবি নজরুলের ভাষায়, তার উপলব্ধির প্রকাশ ছিল_ ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির। শির নেহারি’ আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির!’ সারা পৃথিবী তার মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠল। উচ্চকণ্ঠ হলেন বিশ্বের নেতৃবৃন্দ। পাকিস্তানি জান্তা পশ্চাদপসরণ করল। হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। মহাবীর চির উন্নত শিরে ফিরে এলেন স্বাধীন বাংলাদেশে, তার প্রিয় মানুষের কাছে। বঙ্গবন্ধুর বীরত্বগাথা রূপকথাকেও হার মানায়।
বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন সুদীর্ঘ। তিনি ছিলেন রাজনীতির কবি। আন্দোলনের পর আন্দোলনে রাজনীতির কবিতার ছন্দে ছন্দে জনগণের সংগ্রামকে তিনি টেনে নিয়েছিলেন যৌক্তিক পরিণতির দিকে। বস্তুত, ১৯৪৭ সালে দুই অংশে বিভক্ত পাকিস্তান নামক অস্বাভাবিক রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই রাষ্ট্রভাষা তথা পূর্ববাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিব তখন থেকেই এ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি জেলে ছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়ের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিলেন তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিব। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের মার্শাল ল জারির পর থেকে একনায়কত্ববিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পূর্ববাংলায় অন্যতম প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিব। ততদিনে তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন, পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধিকারের বিকল্প নেই। তাই ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা ঘোষণা করে তার ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তার পর ১৯৬৯ সালে ব্যাপক গণআন্দোলন; আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’ স্লোগানে তুখোড় আন্দোলনের সাফল্য; ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গণভোটের আন্দোলনে প্রায় সবক’টি আসনে বিজয়ী হয়ে স্বাধিকার আন্দোলনকে সেমি-ফাইনালে নিয়ে আসা; সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে ৭ মার্চ স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপরেখা দিয়ে ২৫ মার্চ মধ্যরাত্রির পর মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা প্রদান ও জনযুদ্ধ সূচনার মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়। মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্ব।
 
বঙ্গবন্ধুই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং সর্বাধিনায়ক। তার নামেই পরিচালিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়েই হাজার হাজার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের অনেকেই বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্যই তারা অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা তথা বাঙালি জাতির কাছে স্বাধীনতার অপর নাম বঙ্গবন্ধু। স্মৃতির পাতা ঘেঁটে বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল জীবন থেকে দু’একটি ঘটনা এখনে চয়ন করব।
১৯৪৯ অথবা ‘৫০ সাল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভারত থেকে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলে আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ে তুলেছেন। সারাদেশ ঘুরে ঘুরে তারা সভা করছেন, জনসাধারণকে সচেতন করে তুলছেন এবং নবগঠিত দলকে সংগঠিত করেছেন। এ প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে তাদের সফরসূচি ঘোষণা করা হলো গোপালগঞ্জে। শেখ মুজিবের নিজ এলাকা গোপালগঞ্জে সাড়া পড়ে গেল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মিছিল করে লোকজন জনসভায় আসবে। প্রস্তুতি শেষ। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করল। বিনা মেঘে বজ্রপাত। সবাই বিচলিত, শেখ মুজিব বাদে। শেখ মুজিব কর্মীদের চুপে চুপে কী যেন নির্দেশনা দিচ্ছেন। কর্মীরা দূর-দূরান্তে খবর পেঁৗছে দিচ্ছে- মিছিলগুলো যেন শহরের বাইরে অবস্থান করে। এদিকে এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটল। তখন গোপালগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল বিরাট মধুমতি নদী। এপার থেকে ওপার পরিষ্কার দেখা যায় না। ফেরিতে পার হতে হতো। আরএসএন এবং আই.জি.এন কোম্পানির বড় বড় স্টিমার চলাচল করত খুলনা, গোপালগঞ্জ, গোয়ালন্দ, মাদারীপুর, বরিশাল ও ঢাকা রুটে। খুলনার বনাঞ্চল থেকে হাজার হাজার বাঁশ পাঠানো হতো ঢাকা এবং পথের বিভিন্ন স্থানে। বাঁশ পাঠাতে জলযান লাগত না। কয়েকশ’ বাঁশ একত্রে বেঁধে আয়তক্ষেত্র আকৃতিতে নদীতে ভেলার মতো ভাসিয়ে দেওয়া হতো। কয়েকজন মাঝি তা চালিয়ে নিয়ে যেত। দেখতে প্ল্যাটফর্মের মতো। বেলা ৩টা নাগাদ এমন শ’খানেক বাঁশের প্ল্যাটফর্ম গোপালগঞ্জ ঘাটের পার থেকে ওপার পর্যন্ত পরপর সাজিয়ে বিরাট একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হলো। শেখ মুজিবের গোপন নির্দেশনা অনুযায়ী সুশৃঙ্খলভাবে তিন-চার জনের ছোট ছোট গ্রুপ নদীর পাড়ে এসে বাঁশের প্ল্যাটফর্মে উঠছে। দীর্ঘ নদীতীরের অনেক নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কয়েকশ’ লোক নদীর মধ্যে ভাসমান প্ল্যাটফর্মে উঠল। এক প্রান্তে ছোট একটি টেবিল আর চেয়ার নিয়ে বসেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব। ব্যাটারি চালিত মাইক লাগানো হলো। জনসভা শুরু হল। শেখ মুজিব মাইকে ঘোষণা দিলেন- ‘নদীপথে হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে স্টিমার ও অন্যান্য জলযান চলাচল করে বিধায় নদীর মধ্যে ১৪৪ ধারা কার্যকর নয়। শত শত মানুষ জড়ো হলেও আইন ভঙ্গ হয় নাই। এখন জনসভা শুরু হবে। পুলিশ ভাইয়েরা, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। ভাসমান প্ল্যাটফর্মে ওঠার চেষ্টা করবেন না। জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে নদীতে ফেলে দিলে সে দায়দায়িত্ব আপনাদের। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনুন। আপনাদের কেউ কিছু বলবে না।’ তারপর স্লোগান হলো, বক্তৃতা হলো। মিটিং শেষ হলো সন্ধ্যার পর। শেখ মুজিবের অভূতপূর্ব সৃজনশীল রাজনীতির অনুরূপ ঘটনা আমার জানা নেই। ঘটনাটি বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত একটি বইতে আমি লিখেছি। ওটা পড়ে এবং আমার মুখে পূর্ণ ঘটনাটি শুনে তৎকালীন ‘দি পিপল’ পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমান তার রচিত বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘নীল কমল’ বইটির ৭৭৭ ও ৭৭৮ পৃষ্ঠাজুড়ে সংযোজন করেছেন বঙ্গবন্ধুর তীক্ষষ্ট বুদ্ধির কাহিনীটি।

এবার একটি ব্যক্তিগত ঘটনা বলি। ১৯৭০ সাল। আমি বগুড়ায় হাবিব ব্যাংকের প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করছেন। জনসংযোগ করছেন, জনসভা করছেন। প্রতিটি জনসভাই জনসমুদ্রের আকার ধারণ করছে। গণআন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন পূর্ববাংলার অবিসংবাদিত মহানায়ক। সবাই তাকে এক নজর দেখতে চায়। কাছে থেকে কথা শুনতে চায়। এ প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে তিনি এলেন বগুড়ায়। স্থানীয় প্রধান দৈনিকের সম্পাদক (নাম সম্ভবত আমানুল্লাহ) সকালেই সাতমাথা মোড়ের ব্যাংকে এসে আমাকে খবরটি জানালেন। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী (যতদূর মনে করতে পারছি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম) অফিসে এসে কুশল বিনিময় করলেন এবং জানালেন, দুপুরে বঙ্গবন্ধু কর্মিসভা করবেন, আর বিকেলে জনসভা। আমি দুপুরে কর্মিসভাতে গিয়ে দেখা করলাম। সামান্য আলাপচারিতার পর তিনি বললেন, ‘তোর বগুড়া থাকার দরকার নাই। ঢাকায় চলে আয়।’ এ কথা বলে তার সাচিবিক দায়িত্ব পালনকারী ওমর আলীকে নোট করতে এবং ঢাকায় গিয়ে স্মরণ করাতে বললেন। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বদলির আদেশ পেলাম। ঢাকায় গিয়ে দেখি, আমাকে পোস্টিং দেওয়া হচ্ছে না। চেয়ার নেই, টেবিল নেই, কাজ নেই। বেতনটাই রয়েছে। ওএসডি কথাটা লেখা না থাকলেও কার্যত তেমনই। বঙ্গবন্ধু সফরে ছিলেন। ঢাকা ফিরতেই দেখা করে ঘটনা বললাম। তিনি ঈষৎ ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘মাউড়া ব্যাংকের কাণ্ড! পূর্ববাংলায় কাজ করতে হলে আমার হুকুম মানতেই হবে।’ দু’দিনের মধ্যেই আমার পোস্টিং হয়ে গেল ঢাকার বড় একটি শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে।

১৯৭৪ বা ‘৭৫ সাল। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। খুব ভোরে ফুলের তোড়া নিয়ে গেলাম দেখা করতে। ডাকলেন। ভেতরে গেলাম। একটু চিন্তান্বিত মনে হলো। ফুলটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমার আবার জন্মদিন!’ দার্শনিকের মতো বলে চললেন, ‘জীবন হলো কাজের জন্য। মৃত্যুর আগে অনেক কাজ শেষ করতে হয়। জন্মদিন পালনের সময় কোথায় রে!’ বলে একটু হাসলেন। পারিবারিক কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। বিদায় নিয়ে ফেরার পথে বারবার তার দার্শনিক উক্তি মনে হতে লাগল। কবির ভাষায়, ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য।’ জীবন ভরে কর্ম থাকবে নিত্য। ১৫ আগস্ট নিষ্ঠুরতার আঘাতে তার কর্মযজ্ঞ স্তব্ধ হওয়ার পর তার এই দার্শনিক উক্তিগুলো মনের কোণে জেগে উঠত। স্মরণে আসছে কবিতার পঙ্ক্তি- ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’

সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।

নোট: সমকাল থেকে নেয়া।

SUMMARY

2119-1.jpg